মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ। ১২ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।
ঐতিহাসিক ইবনু খালদুনের মতে, আদম (আ.) এর দশম অধস্তন পুরুষ নুহ (আ.)। বংশপরিক্রমা হলো : আদমপুত্র শিশ, শিশপুত্র আনু, তাঁর পুত্র কাএন, তাঁর পুত্র মাহলাএল, তাঁর পুত্র য়্যারবু, তাঁর পুত্র ওখনুখ, তাঁর পুত্র মুতাশলাখ, তাঁর পুত্র লামাক, লামাকপুত্র নুহ (আ.)। নুহ (আ.)-এর চার পুত্র : সাম, হাম, ইয়াফিছ ও ইয়াম অথবা কেনআন।
হামের পুত্রগণ : হিন্দ, সিন্ধ, হাবাস, জানায, বার্বার, নিউবাহ।
হিন্দের পুত্রগণ : (ক) বঙ্গ (বঙ্গ থেকে বঙ্গদেশ/ বাংলাদেশ), (খ) পুরব, (গ) দখিন, (ঘ) নাহরাওয়াল।
মহাপ্লাবনের পর নুহ (আ.)-এর বংশধররাই নতুনভাবে পৃথিবী সাজিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ গোলাম হোসায়ন জইদপুরি ১৭৬৬-১৭৮৮ সালে রচনা করেন ফারসি গ্রন্থ ‘রিয়াজ উস সালাতিন’। তিনি নুহ (আ.)-এর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা সম্পর্কের বিষয় উত্থাপন করেছেন।
[সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ২৮]
তিনি লিখেছেন, নুহ (আ.)-এর পুত্র হামের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুণ এই অঞ্চলের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়। সিন্ধ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে এসে সিন্ধু দেশে বসতি স্থাপন করায় এই অঞ্চলের নাম তাঁরই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বংয়ের (বঙ্গ) সন্তানেরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিল বঙ।
[সূত্র : গোলাম হোসায়ন সলিম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিনের বঙ্গানুবাদ, আকবরউদ্দীন অনূদিত, অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)]
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ হাননানের মতে, আনুমানিক ১০ হাজার বছর পূর্ব থেকে বাঙালি জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল।
আরেকটি সূত্র মতে, বাঙালি জাতি এসেছে নুহ (আ.)-এর বংশ থেকেই। [সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান, বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ৬৪৪, ৩১)]
অন্যত্র তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাস নুহ (আ.)-এর সময় থেকেই শুরু এবং এ থেকেই অনুমান করা যায় এর ইতিহাসের প্রাচীনতার বিষয়টি। [সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান, বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ৬৪৪, ৩০]
ড. মোহাম্মদ হাননান আরো লিখেছেন, নুহের সময়ের মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নুহ (আ.)-এর অনুসারী; এই ৮০ জন থেকেই মানবজাতির আবার নতুন যাত্রা।
বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে নুহ (আ.) তাঁর পুত্র হামকে বলেন, তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্য চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। হাম তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নামানুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান।
হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। এই ‘বঙ্গ’-এর সন্তানরাই বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করে। এই বর্ণনা সত্য হলে বলতে হবে বাঙালির আদি পুরুষ হচ্ছেন ‘বঙ্গ’। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান, দেশের নামটি বাংলাদেশ কে রেখেছে এই নাম, অনুপম প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬)
বঙ্গ ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের যে স্থানে এসে বসতি স্থাপন করে সেই স্থানের নাম তাঁরই নামানুসারে হয় বঙ্গদেশ অথবা বঙের সন্তানরাই বঙ্গাল বা বাঙ্গাল অথবা পরবর্তীকালে বাঙ্গালী, আরো পরে বাঙালি বলে খ্যাতি লাভ করে। [সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান, বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ২৯)]
অতএব, সুনিশ্চিতভাবে বঙ থেকেই বাঙালি জাতির সৃষ্টি বা উৎপত্তি ও বাংলাদেশের গোড়াপত্তন।
বাঙ্গালাহ চৌদ্দ শতকে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমল থেকে রাজ্যের নাম হিসেবে স্পষ্টভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাক-মুসলিম যুগে রাজ্যটি গৌড়, রাঢ়, বঙ্গ, পুণ্ড্র, সমতট প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল।
জিয়াউদ্দিন বরনিই হলেন প্রথম মুসলিম ঐতিহাসিক, যিনি ইকলিম-ই-বাঙ্গালাহ অথবা দিয়ার-ই-বাঙ্গালাহ (যার দ্বারা তিনি বাংলাকে বুঝিয়েছেন) শব্দগুলো ব্যবহার করেন। ইলিয়াস শাহ কর্তৃক লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁ একত্র হওয়ার পর শামস-ই-সিরাজ ইলিয়াস শাহকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ এবং ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মুঘল আমলে ‘বাঙ্গালাহ’ ‘সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ প্রদেশ নামে পরিচিত হয়। এ নামটিই পর্তুগিজ বিবরণে বেঙ্গালা ও ইংরেজদের বেঙ্গল।
ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘বাঙ্গালাহ’র উৎপত্তি সম্পর্কে জানান, আগের শাসকরা সমগ্র প্রদেশে পাশে ২০ গজ এবং উচ্চতায় ১০ গজ উঁচু বাঁধ নির্মাণ করেন। এগুলোকে ‘আল’ বলে। বঙ ও আল যুক্ত হয়ে দেশটির বাঙ্গালাহর উৎপত্তি এবং তা ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে…(আবদুল মমিন চৌধুরী)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর।
Leave a Reply