নোয়াখালীর উপকূল রক্ষায় প্রতিশ্রুতি আছে, পদক্ষেপ নেই

  • আপডেট সময় শনিবার, নভেম্বর ১১, ২০২৩
  • 106 পাঠক

——————————————————————————————————প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদী ভাঙনে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২’শ কোটি টাকা

—————————————————————————————————-

দিশারী ডেস্ক। ১১ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

সিডিএসপির প্রকল্প কর্মকর্তা প্রকৌশলী শংকর চন্দ্র সাহার মতে, ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর ১’শ মি. থেকে ৫’শ মি.পর্যন্ত ভূমি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর মেঘনা তীরবর্তী এলাকা ছাড়াও জেলার হাতিয়া উপজেলার নদীর এপারে বয়ার চর, নলের চর, নাঙ্গলিয়া, কেরিং চর বিস্তৃত এলাকা নিয়মিত ভাঙনের স্বীকার হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদী ভাঙনে প্রায় ২’শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিনে ও পর্যবেক্ষণে জানা যায়, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন অংশে এবং সুবর্ণচরের আমিন বাজার থেকে জনতা ঘাট পর্যন্ত মেঘনা নদীর তীব্র ভাঙনে গত ১২ বছরে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি, ভিটা-মাটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, হাট-বাজারসহ কৃষি জমি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবলে সর্বোচ্চ হারিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অসহায় পরিবারের সদস্যরা।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ভরপুর মেঘনা বিধৌত এ জেলার ভাঙা-গড়ার ইতিহাস বহু পুরনো হলেও বর্তমানে নদী ভাঙন রোধ করা যায় বলে মনে করছেন মেঘনা তীরবর্তী মানুষেরা।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, উপকূল রক্ষায় ভাঙন রোধে বিগত কয়েক বছর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি পেলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ পাননি তারা।

স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা দলের সভাপতি আরিফুল ইসলামের মতে, ২০২০ সাল পর্যন্ত স্নুইস গেট ৩টি, বেড়িবাঁধ প্রায় ৩৫ কি.মি., ক্লোজার ৪টি, পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির ঘর ২টি, সাইক্লোন শেল্টার ৭টি, কাঁচা ও পাকা রাস্তা ৫০কি.মি., কালভার্ট ৯টি, ইউড্রেন ১০টি, উন্নয়নকৃত বাজার ১টি, অন্যান্য বাজার ৫টি, মাটির কিল্লা ৭টি, গভীর নলকূপ ৩১১টি, পিট লেট্রিন ৫০টি, বনায়নকৃত অঞ্চল ৪ হাজার হেক্টর, বাঁধ ও রাস্তা (বনায়ন) ৬৩ কি.মিসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অসংখ্য বসত বাড়ি ।

স্থানীয়রা জানান, আমরা এক সময় নদীর কাছাকাছি বাড়ি নির্মাণ, নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম এবং ফসলি জমিতে ফসল ফলায় সংসার চালাইতাম। কিন্তু এখন তো সব হারিয়ে বেড়িবাঁধের কুলে সর্বশেষ জীবন যাপন। যে হারে নদী ভাঙছে এটাও কয়েক বছরে হারিয়ে যাবে নদীতে।

কথা হয় আমিন বাজার মসজিদের ইমামের সাথে তিনি জানান, এখানে করোনাকালীনও মসজিদে নামাজ হতো কিন্তু করোনা শেষ হওয়ার আগে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় মসজিদটি। তাছাড়া কথা হয় উপজেলার ৮ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নুর আলমের সাথে ।

তিনি জানান, চর মুজাম্মেল ও চর নোমান এবং চর খন্দকার ছিলো দক্ষিণে বিস্তৃত। কিন্তু কয়েক বছরে নদী ভাঙনে হারিয়ে যায় চর মুজাম্মেল ও চর নোমান এবং চর খন্দকার। স্মৃতি হিসেবে রয়েছে চর নোমানের ও চর খন্দকারের কিছু অংশ। কিন্তু একেবারে হারিয়ে যায় চর মুজাম্মেল।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মধু জানান, আমরা আমিন বাজারে ব্যবসা করতাম, ব্যাপকহারে বেচাকেনাও হতো। আমাদের আমিন বাজারের দক্ষিণের মানুষ গুলো আসতো এই বাজারে তাদের পন্য বিক্রি ও নিত্য পন্য ক্রয় করাসহ সব কিছুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিলো আমিন বাজার। কিন্তু ২০১৯ সালে ও ছিল বাজারের কিছু অংশ যা ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগে নদী গর্ভে হারিয়ে যায় বাজারটি।

কথা হয় একজন স্থানীয় এক জেলের সাথে। তিনি জানান, আমরা বাগান থাকাকালীন এই চরে বসবাস করতেছি। চাষাবাদের পাশাপাশি নদীতে মাছ ধরে জীবন যাপন করছি। তাছাড়া পরবর্তীতে এখানে বেড়িবাঁধের পর এখানে বড় করে বাজার করা হয়েছিলো। সেখানে আমরা যারা জেল তাদের মাছ বেচাকেনা হতো। একদিকে সময় বেঁচে যেতো, অন্য দিকে যে কোনো সময় মাছ বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু এখন একদিকে আমিন বাজার অন্য দিকে নিজের বসত বাড়ি হারিয়ে এখন থাকি বরইতলার পাশে।

এছাড়াও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, আমরা বসত বাড়ির আঙ্গিনাতে থাকা জমিতে সবজি চাষ করে সংসার চালাইতাম। কিন্তু এখন তো সব হারিয়ে ফেলছি। এখন থাকি অন্যের বাড়িতে। কিছু করার নাই কারণ আমাদের তো থাকার মতো কোনো জায়গায়ও নেই।

রাবেয়া নামক একজন জানান, নদী ভাঙনে জাগা জমি সব কিছু চলে গেছে। আমাদেরকে সরকারিভাবে কেহই কিছু দেয়নি। আমরা এখন মানুষের বাড়ি থাকি।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, আমাদের জমি গুলো ছিলো ফসলি। যেকোনো ফসল চাষ হতো। এ চরে ব্যাপকভাবে এক সময় চাষ হতো ধানের পাশাপাশি তরমুজ। তাছাড়া নতুন চরে চাষ হতো খেসারির ডাল। যা এখানে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কিন্তু নদী ভাঙনের আগে এখানে তরমুজ চাষ করে ব্যাপক লাভ হয়েছে আমাদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সীম, তরমুজ চাষ ছিলো বেশ জনপ্রিয়। প্রতিবছর কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হতো এই চর থেকে। মানউন্নয়ন হয়েছিলো স্থানীয় মানুষের।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের জন্য ছিলো আনন্দ স্কুল ‘‘ আর নয় ঝড়ে পড়া, আনন্দ স্কুলে লেখা পড়া ’’ এই প্রতিপাদ্যে প্রতিটি স্কুলে ছিলো ১ জন শিক্ষক ও ৩০ জন ছাত্রছাত্রী। এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ওই স্কুলগুলো এখন নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায়তে চলে গেছে শিক্ষার্থীরা।

বনায়নের জন্য বেশ উপযোগী ছিলো এই চরটি।-নদী তীরবর্ত্তী এলাকা গুলো সেখানে নদী ভাঙন রোধে লাগনো হয়েছে বিশেষ প্রজাতির গাছ। তাছাড়া বনবিভাগ কর্তৃক আমিন বাজারের দক্ষিণ পূর্ব পাশে করা হয়েছে নারকেল বাগান, কিন্তু নারকেল ধরার আগে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় বাগানটি।

জানা যায়, বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) হিসেব অনুযায়ী, নোয়াখালীতে ৭০ বছরে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি ক্ষয় হলেও একই সময়ে নতুন করে এক হাজার বর্গকিলোমিটার যুক্ত হয়েছে।

নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত অ্যাকচুয়ারি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইডিপি) গবেষণা ও জরিপ কার্যক্রমে দেখা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নোয়াখালী উপকূলে ৫৭৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদী থেকে জেগে ওঠেছে। আবার একই সময়ে জেগে ওঠা ভূমির ১৬২ বর্গকিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে টিকেছে ৪১১ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন প্রান্তে জেগে ওঠা চরের পরিমাণ অন্তত ২০ বর্গকিলোমিটার বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পরিচালিত মেঘনা মোহনা সমীক্ষায় এ তথ্য পাওয়া যায়। আশির দশকের শেষভাগ থেকে জেগে ওঠা চরভূমির পরিমাণ বাড়ছে।

পাউবো সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে, নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় ভূমিপ্রাপ্তির হারই বেশি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!