দালালের ওপর ভর করেই কর্মকর্তার পকেট ভারী

  • আপডেট সময় শনিবার, এপ্রিল ২৪, ২০২১
  • 980 পাঠক

———————————————————————————————————

পাসপোর্ট অধিদপ্তর

———————————————————————————————————

দিশারী রিপোর্ট , নোয়াখালী

দালাল দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে সেবা প্রত্যশীরা। দালাল ছাড়া কোনভাবেই সহজ হয়ে ওঠেনা নাগরিক পাসপোর্ট। এমন চিত্র নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নিত্যকার ঘটনা।

তবে দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগের আওয়াজ বিদারিত হলেও তাদের ওপর ভর করে সব সুবিধাই ভাগিয়ে নিচ্ছেন কাযালয়ের কতেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

সূত্র জানায়, উপর্র্যোপুরি খাটুনির পর প্রতিটি বই হতে দালাল নামমাত্র কতেক টাকা পেলেও বাকীটাই চলে যায় কার্যালয়ের ওসব কর্মকর্তা আর কর্মচারীর পকেটে।

দিনদিন এই অধিদপ্তরটি যেন দালালদের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সেবাগ্রহীতারা দালালদের মাধ্যম ছাড়া এই দপ্তরে গেলে তাদের ভাগ্যে জোটে শুধুই দুর্ভোগ, হয়রানি আর ভোগান্তি।

জানা গেছে, সেবাগ্রহীতা এবং দপ্তরের লোকজনের কাছে দালালদের মাধ্যমটি ‘চেইন’ নামে পরিচিত। সেবা প্রত্যাশী জিলানী, জহির, বেলাল, শাহাদাৎ জানান, দালালের মাধ্যম ছাড়া আবেদন জমা দিলে ১৫ দিনের পাসপোর্ট অনেক সময় ৬ মাসেও পাওয়া যায় না। এতে অনেকের সঠিক সময়ে বিদেশ যাওয়া বাতিল হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অথচ দালালের ‘চেইনে’ গেলে সঠিক সময়ের আগেও মিলছে পাসপোর্ট।

সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পাসপোর্ট অধিদপ্তরে দালাল ছাড়া কোন কাজ করতে গেলে সেবাগ্রহীতাদের পদে পদে ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হতে হয়।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে পাসপোর্ট তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি এখন দালালদের কব্জায়। তাদের ‘চেইন’ ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে নানা ছুঁতোনাতোয় ভাগ্যে জোটে হয়রানি।

শুরু হয় নানান ধরণের প্রতিবন্ধকতাও। বাধ্য হয়ে সেবা প্রত্যাশীরা এসব ভোগান্তির অভিযোগ নিয়ে যেতে হয় উপ-পরিচালকের কাছে। সেখানেও তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা করতে হয় অপেক্ষা।

জানা গেছে, ইতোপূর্বে এ দপ্তরে বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে কযেকজন দালালকে আটক করেছিল ডিবি পুলিশ। এসব অভিযানে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অনেকগুলো পাসপোর্ট, বিভিন্ন সিল, ভুয়া সনদ, ভুয়া সার্টিফিকেটসহ অনেক কাগজপত্র।

সে সময় আটককৃতরা অবৈধপথে পাসপোর্ট তৈরির সঙ্গে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কতেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত থাকার কথা জানিয়েছে। কিন্তু এখনো কমেনি দালালের দৌরাত্ম্য।

ইতোমধ্যে, অনেক দালাল অন্য ব্যবসার নাম করে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের গেইটে দালাল দপ্তর খুলছে বলেও অভিযোগ করেন এলাকার বিশিষ্ট নাগরিক জাফর আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের গেইটে চাকচিক্যময় অনেকগুলো ষ্টেশনারী দোকান রয়েছে। বাস্তবে এগুলোর প্রায় মালিকই দালালীর সাথে সম্পৃক্ত।

সূত্র জানায়, সরকারি নিয়মে ২১ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৩ হাজার ৪৫০ টাকা, আর জরুরি প্রয়োজনে ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৬ হাজার ৯শ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন।

দালালেরা ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্টের জন্য সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, আর ২১ থেকে ২৫ দিনের জন্য নিচ্ছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও দ্বিগুণ টাকা নিচ্ছেন দালালেরা।

সরেজমিনে পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকে মাসের পর মাস ঘুরেও পাসপোর্ট না পাওয়ার কথা বলছেন এক ভুক্তভোগী। এ সময় এক সরকারী কর্মকর্তা বলে ওঠেন, আমি নিজেও পাসপোর্ট করেছি দালালের মাধ্যমে। দালালের মাধ্যমে না গেলে আমাদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়।

জেলার হাতিয়ার উপজেলার মোস্তফা বলেন, আমি অনলাইনে ই-পাসপোর্টের আবেদন করে জমা দিতে গেলে তারা আমার আবেদন জমা নিতে চায়নি। এটা-ওটা ভুল হয়েছে বলে আমাকে সারাদিন ঘুরিয়েছে। পরে অফিসের এক লোক বলল ‘চেইনে’ আসলে এই সমস্যা হতো না।

শেষপর্যন্ত নিরুপায় হয়ে একজন সাংবাদিকের পরামর্শে উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে জমা দিয়েছি। তবে দালাল মাধ্যমে না করার কারণে ওই পাসপোর্ট সঠিক সময়ের অনেক পরেই হাতে পেয়েছি।

জেলার সদর উপজেলার বাসিন্দা শাহনাজ বলেন, দালাল ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। তাতেও জমা দিতে নানা ভোগান্তি। এই ভুল-ওই ভুল। আসলে সবই হয়রানির কৌশল। তিনি বলেন, যে সময়ে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা ছিলো সেই সময়ে না পাওয়ায় তার বিদেশ যাওয়া বাতিল হয়েছে।

ধর্মপুরের জিলানী বলেন, ১৫ দিন আগে দালালের মাধ্যমে চেয়ারম্যান কর্তৃক নাগরিক সনদ ও জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্ট আবেদন জমা দিয়েছি। আর ১৫ দিন পরে আমার ভাতিজা মুন্নার জন্যে দালাল ছাড়া জমা দিতে গেলে বলে জন্মনিবন্ধন দিয়ে হবেনা। স্মার্ট কার্ড লাগবে। কিন্তু এখনো যে আমার স্মার্ট কার্ড বের হয়নি। পরে উপ-পরিচালকের সাথে দেখা করে কোন রকমে জমা দিয়েছি।

তবে অনেক সময় আবেদনকারীরা সমস্যাজনিত কারণে উপপরিচালকের সাথে দেখা করতে গেলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নামের এক ব্যক্তি দরজায় দাঁড়িয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এ সময় ওই ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা ধরিয়ে দিলেই তিনিই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বুঝে নেন।

সুবর্ণচর থেকে আসা রিয়াজ মিয়া বলেন, হয়রানি আর বিদেশ যাত্রা বাতিল হওয়ার ভয়ে ৩ হাজার ৪৫০ টাকার পাসপোর্ট দালালের মাধ্যমে ৯ হাজার দিয়ে করিয়েছি। দালাল সময় নিয়েছিলো এক মাস। কিন্তু তিনি ২৬ দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে। এই অফিসের দালাল ছাড়া এখন কোন কাজই হয় না।

এসব প্রসঙ্গে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মহির উদ্দিন সেখ বলেন, প্রিন্টিং সমস্যার কারণে অনেক সময় পাসপোর্ট আসতে দেরি হয়। এছাড়া আবেদনে তথ্যগুলো ভুল, পুলিশ প্রতিবেদন দেরিতে আসাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণেও মানুষ সঠিক সময়ে পাসপোর্ট পায় না। তবে যেকোন সেবাগ্রহীতা আমার কাছে আসলে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি দ্রæত সমস্যা সমাধান করার জন্য।

দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর থেকেই সকল কিছু নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে মানুষ এখন ভালো সেবা পাচ্ছে, সরকারি ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট পাচ্ছে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!