শবেবরাতে করণীয় ও বর্জনীয়

  • আপডেট সময় রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪
  • 159 পাঠক

আসআদ শাহীন । ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

শাবান মাসের ১৫তম রাতকে বলা হয় ‘শবেবরাত’। এই নামটি একটি ফার্সি ও একটি আরবি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। শব শব্দটি ফারসি, অর্থ রাত আর বারাআত শব্দটি আরবি, অর্থ মুক্তি। দুটি মিলে অর্থ হয় মুক্তির রাত।

যেহেতু এই রাতে অগণিত মানুষের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং বহু জাহান্নামিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়, তাই এই রাতটি শবেবরাত বা মুক্তির রাত নামে পরিচিত।

কোরআন শরিফে শবেবরাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রাত হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। আর হাদিসে শবেবরাতকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রাত তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) বলেন, শবেবরাতকে শবেবরাত বলা হয় এই কারণে যে এ রাতে দুই প্রকারের বরাত (মুক্তি) হয়ে থাকে।

এক. অপরাধী ও হতভাগাদের আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। দুই. যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাদের বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত, অপমান-লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দান করেন। (গুনিয়াতুত তালেবিন, পৃষ্ঠা ৪৫৬)।

হাদিসে শবেবরাতের অনেক গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

অগণিত মানুষের ক্ষমা :

আয়েশা (রা.) বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বিছানায় না পেয়ে ঘর থেকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে ( মদিনা তায়্যিবার কবরস্থান ) গিয়ে পেলাম। তিনি আমাকে বলেন, তুমি কি আশঙ্কা করো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর কোনো অন্যায় করবেন ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে চলে গিয়েছেন বলে আমার ধারণা হয়েছিল।

তিনি বলেন, শোন, আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন। আর বনু কালব (বনু কালব ছিল আরবের একটি গোত্র, তাদের কাছে আরবের সব গোত্রের চেয়ে বেশি ছাগল ছিল) গোত্রের বকরি পালের লোমের সংখ্যার চেয়েও বেশিসংখ্যক লোককে তিনি ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯)।

যাদের এ রাতে ক্ষমা করা হয় না :

আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া তাঁর সৃষ্টির সবাইকে ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ৯৯; শুআবুল ঈমান : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৮২)।

মাশাহানের তাফসির অনুযায়ী, উপরিউক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে সেসব বিদআতিও তার অন্তর্ভুক্ত যারা মুসলিম জামাত থেকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। (মুসনাদ ইসহাক বিন রাহাবিয়া : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৯৮১, হাশিয়ায়ে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ৯৯)।

শবেবরাতে করণীয় :

উল্লিখিত হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে এ রাতে ইবাদতের কোনো ধরন নির্দিষ্ট নেই; বরং এ রাতে এমন সব নেক আমল করা উচিত যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভ করা যায়। তাই এ রাতে আমরা নিম্নোক্ত আমল করতে পারি।

এক. জামাতে নামাজ আদায় : মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ অবশ্যই জামাতের সঙ্গে আদায় করা।

দুই. নফল নামাজ পড়া : এ ক্ষেত্রে অনির্ভরযোগ্য কিছু বই-পুস্তকে নফল ইবাদতের বিভিন্ন নিয়মের কথা উল্লেখ আছে। যেমন—এত রাকাত পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে এই এই সুরা এতবার পড়তে হবে। অথচ সহিহ হাদিসে শবেবরাত, শবেকদর বা অন্য কোনো ফজিলতপূর্ণ রাতে এসব বিশেষ পদ্ধতির কোনো নামাজ প্রমাণিত নেই।

তিন. তাওবা করা : 

(ক) কৃতপাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। (খ) তৎসঙ্গে উক্ত পাপটি পরিহার করা। (গ) ভবিষ্যতে উক্ত পাপটি আর করব না—মর্মে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করা। (ঘ) বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে তার হক আদায় করে কিংবা ক্ষমা গ্রহণ করে দায়মুক্ত হওয়া। (ঙ) কোনো ফরজ-ওয়াজিব ছুটে গিয়ে থাকলে মাসআলা অনুযায়ী তার কাজা-কাফফারা আদায় করা। অতঃপর আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা এবং অন্তর থেকে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

চার. কোরআন তিলাওয়াত করা, দরুদ শরিফ পড়া, জিকির-আজকার করা ও ইস্তিগফার পড়া ইত্যাদি।

পাঁচ. এ রাতে গুরুত্ব সহকারে দোয়া করা, কারণ এ রাতে দোয়া কবুল হওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ আছে।

ছয়. এ রাতে সাধ্যমতো কিছু দান-সদকা করে এবং নফল ইবাদত করে মৃতদের জন্য সওয়াব পৌঁছানো।

সাত. ১৫ শাবান নফল রোজা রাখা। রোজা রাখার বিষয়টি উল্লিখিত হাদিস ছাড়াও অন্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

আট. সালাতুত তাসবিহ আদায় করা যেতে পারে। সালাতুত তাসবিহের নিয়ম কোনো আলেম থেকে জেনে নিতে হবে।

শবেবরাতে বর্জনীয় বিষয়

শয়তান মানুষকে এই রাতে নেক আমল থেকে বিরত রাখার জন্য কিছু কুসংস্কারের প্রচলন ঘটিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কিছু মানুষ এগুলোকে নেক কাজ মনে করে শুধু বিভ্রান্তই হচ্ছে। এজাতীয় কিছু কুসংস্কারমূলক কাজ হলো—

১. আতশবাজি, ফটকা ইত্যাদি ফুটানো ও ঝাড়বাতি জ্বালানো।

২. মসজিদ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও অন্যান্য জায়গায় আলোকসজ্জা করা। এসব অপচয়ের শামিল। তা ছাড়া এটি বিধর্মীদের উৎসবের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও বর্জনীয়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩১)।

৩. হালুয়া-রুটি, বাতাসা, মিষ্টান্ন ও খিচুড়ি পাকানো। এগুলোকে এ রাতের বিশেষ কাজ মনে করা হয়। মা-বোনদের দামি সময় নষ্ট হয়, মসজিদে হৈচৈ ও শোরগোল হয়। ইবাদত করার পরিবেশ নষ্ট হয় এবং এগুলোর পেছনে পড়ে এ রাতের তাওবা-ইস্তিগফার, নফল ইবাদত ইত্যাদি ছুটে যায়। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম, খণ্ড ২, পৃ. ৬৩২, আল মাদখাল লি ইবনিল হাজ্জ, ১/২৯৯ ও ১/৩০৬)।

তবে ইবাদতের অংশ মনে না করে নিছক সংস্কৃতি হিসেবে ভালো-মন্দ খাবার তৈরি ও গ্রহণ করলে কোনো অসুবিধা নেই।

পরিশেষে এ রাতে আনুষ্ঠানিকতা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ বর্জন করে নিবিড়ভাবে নফল ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

বিশেষ জ্ঞাতব্য : এ রাতে কবরস্থানে যাওয়া। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রাতে কবর জিয়ারত করেন; কিন্তু উল্লেখ্য যে মহানবী (সা.)-এর এই আমল এতটাই গোপন ছিল যে তিনি তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কাছ থেকেও তাঁর প্রস্থানের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন এবং কোনো সাহাবিকেও সঙ্গে নেননি। আর পরবর্তী সময়েও কোনো সাহাবিকে এ কাজে উৎসাহিত করা প্রমাণিত নয়। তাই শবেবরাতে দল বেঁধে কবরস্থানে যাওয়া, এটিকে শবেবরাতের অংশ ও আবশ্যিক মনে করা, রাস্তায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা—এগুলো দ্বিনের দিক থেকে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন। বরং কবরস্থানে একাকী চুপিসারে যাওয়া, কোনো বন্ধুবান্ধব বা ঘোষণা দিয়ে না যাওয়া উচিত।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!