শুধু বাংলা নয়, ভারত ও মায়ানমারের বর্জ্যও বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়

  • আপডেট সময় সোমবার, এপ্রিল ২২, ২০২৪
  • 54 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২২ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

দিন দিন ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের কবলে পড়ে নালায় পরিণত হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রোপকূলে প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১০ম স্থানে রয়েছে।

এক তথ্য অনুসারে দেশের ভেতরের বিভিন্ন নদনদী থেকে শুধু ৯ হাজার ৭৬৭.৩২ টন সিঙ্গেল ইউজ বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বর্জ্য দৈনিক বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে।

এ ছাড়া দেশের বাইরে ভারত থেকে ১ হাজার ৪৯৩.৮০ টন ও মায়ানমার থেকে ২৪৮.৫৬ টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্যও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দৈনিক বঙ্গোপসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে। যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৯.৬৮ টন।

প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল।

তবে, প্রায় দুই দশক পর পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এসডোর (এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশের পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ৮৭ শতাংশই সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ফেলা হয় না।

এসব বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে নদীতে মিশে শুধুমাত্র পানির নিচের জীববৈচিত্র্যকেই না, বরং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।

শুধু নদী দূষণ করেই ক্ষান্ত না, প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দূষণের জন্যও দায়ী। এসডোর করা ‘ দ্য ট্র্যাজিক টেল অব আওয়ার রিভার ’ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন নদনদী থেকে শুধু সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য দৈনিক কত পরিমাণ বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে তার একটা হদিস পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের ভেতরে মহানন্দা নদী থেকে ১০ টন, ডাহুক থেকে ১০.১৪ টন, করতোয়া থেকে ১১.২৩ টন, ধরলা থেকে ১০.৯১ টন, তিস্তা থেকে ১২.০২ টন, দুধ কুমার থেকে ৪১২.৯১ টন, ব্রক্ষ্মপুত্র থেকে ১১৫২.০৮ টন, সোমেশ্বরী থেকে ৪১৫.৩১ টন, কংস নদী থেকে ৩৮৭.০৩ টন, সুরমা থেকে ৪৪১.৩৪ টন, কালনি থেকে ৪৩০.৭০ টন, কুশিয়ারা থেকে ৪২৮৭.৮৪ টন, পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে ২৩৭৯.৯৬ টন, মাতামুহুরি থেকে ৪৯৯.৭২ টন, পশুর থেকে ৩৭৪.৮৫ টন, ইছামতি থেকে ৪৪৮.৫৯ টন ও নাফ থেকে ৯৭৫.৫৪ টন বঙ্গোপসাগরে মেশে।

বিভিন্ন জাহাজ ও নৌযান থেকে দৈনিক বঙ্গোপসাগরে ফেলা হয় ১৩৬৬.০৪ টন বর্জ্য। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভারত থেকে ১৪৯৩.৮০ টন ও মায়ানমার থেকে ২৪৮.৫৬ টন বর্জ্য দৈনিক বঙ্গোপসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে।

কক্সবাজারের মতো এলাকায়, পর্যটক এবং দর্শনার্থীরা সমুদ্র সৈকতে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের জিনিস ফেলে দেয়। এসব বর্জ্য শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।

আবার যেসব প্লাস্টিকের পণ্য বা প্যাকেট রাস্তায় ফেলা হয় বা নদীর তিরে ড্যাম্প করে রাখা হয়, বৃষ্টিপাতের সময় এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খাল, নালা ও নদীপথে জমা হয়। এসব বর্জ্য নালা এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আটকে রাখে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঢাকা শহরের ৬৫টি খালের মধ্যে ২২টি এখন ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্য বিভিন্ন উপায়ে পানিতে মিশে ধীরে ধীরে সেখান থেকে মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়।

এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপকভাবে পানির নিচের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। মাছসহ পানির নিচের অন্যান্য প্রাণী এসব মাইক্রোপ্লাস্টিককে খাবার ভেবে গ্রহণ করে। ফলে মারাত্মক এক হুমকির মুখে রয়েছে পানির নিচের জীববৈচিত্র্য।

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি) তাদের বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে। এ ছাড়া ভারত, নেপাল ও চীনের বর্জ্য গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে ভাসছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, যা এই দেশের পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। আরও বলা হয়, আনুমানিক ২.৬ মিলিয়ন টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিবছর আমাদের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে, যার মধ্যে বিরাট এক অংশ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশের আন্তসীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫,৩৪৫ টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য বহন করে, যার মধ্যে ভারত থেকে ২৫১৯ টন এবং মায়ানমার থেকে আসে ২৮৪ টন।

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘শকিং স্ট্যাটিস্টিকস অন প্লাস্টিক ইন বাংলাদেশ’ নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে।

শুধু ঢাকা শহরেই ১৪ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়। এসব বর্জ্যের অধিকাংশই দিন শেষে কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে মিশে, তারপর একসময় এর ঠাঁই হয়ে সমুদ্রে। আরও বলা হয়, দেশে ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

২০২১ সালে প্রকাশিত বিডার (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে লালবাগ, হাজারীবাগ ও সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকাসহ সারা দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি ফ্যাক্টরি রয়েছে।

শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই প্রতি মাসে স্ট্র, গ্লাস, প্লেট, চামচসহ ২৫০ টন ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের পণ্য কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্য ও প্রসাধনীর প্যাকেটে ব্যবহৃত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দেশে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিভিন্ন পণ্যের প্লাস্টিকের মিনিপ্যাক মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এসব মিনিপ্যাকের ব্যবহারও দেশে প্লাস্টিক দূষণের একটি বড় উৎস। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এসডোর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের মূল উৎস পলিথিনের ব্যাগ।

তা ছাড়া মানুষ প্রতিবছর প্রায় ৮৭ হাজার টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ফেলে দেয়। এই বর্জ্যের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসে খাদ্য ও প্রসাধনী আইটেম থেকে, যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ অপুনর্ব্যবহারযোগ্য মিনিপ্যাক।

২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে প্রতিবছর ৩ কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে প্রতিবছর ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই প্লাস্টিকের গড় ব্যবহার ২০০৫ সালে বার্ষিক ৯.২ কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২২.২৫ কেজি হয়েছে।

এসডোর সিনিয়র প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মালিহা হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণের মাধ্যম হলো পলিথিনের ব্যাগ। বাংলাদেশ সরকার আইন করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিলেও, কঠোরভাবে এই আইন নিরীক্ষণ না করার কারণে মানুষ দেদার পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছে। প্লাস্টিকের মধ্যে তের শরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। পলিথিনের ব্যাগসহ প্লাস্টিকের পণ্যগুলো পচনশীল না হওয়ার কারণে এগুলো যখন নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে গিয়ে মিশে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়।

এসব মাইক্রো প্লাস্টিক মেরিন জীববৈচিত্র্যকে তো ধ্বংস করেই, সঙ্গে মানবদেহেও অনেক বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসব মাইক্রো প্লাস্টিক বিভিন্ন মাধ্যমে মাছের পেটে যায়, এসব মাছ আবার যখন মানুষ খাবার হিসেবে গ্রহণ করে, তখন তা মানবদেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় মায়ের বুকের দুধ, এমনকি ভ্রুণের মধ্যেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!