অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত মুনাফা হারাম

  • আপডেট সময় রবিবার, জুন ২, ২০২৪
  • 153 পাঠক

কাসেম শরীফ ।৩১ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। 

মুনাফা মানে লভ্যাংশ। ক্রয়-বিক্রয়ের লাভ। যেমন বলা হয়, ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় লাভ করেছে, তার ব্যবসা লাভজনক হয়েছে। (আল-মুজামুল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা-৩২২)

পবিত্র কোরআনে এ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, কিন্তু তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত হয়নি। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৬)

ইমাম রাগিব ইস্পাহানি মুনাফার সংজ্ঞায় বলেন, ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত বাড়তি সম্পদকে মুনাফা বলা হয়। পরোক্ষ অর্থে, কর্মের ফল হিসেবে যা কিছু ফিরে আসে, তা বোঝায়।’ (আল-মুফরাদাতু ফি গারিবিল কোরআন, পৃষ্ঠা-১৯১)

সহজ ভাষায়, পুঁজির বর্ধিত অংশ মুনাফা বা লাভ। আর পুঁজির ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ হলো লোকসান।

মূলধন যদি বেড়ে যায়, তা হলো মুনাফা। অন্যদিকে পুঁজি যদি এর মোট পরিমাণের চেয়ে কমে যায় তাহলে এর হ্রাসপ্রাপ্ত অংশকে বলা হয় লোকসান।

মুনাফা ও সুদ

মুনাফার মতো পুঁজির আরেক বর্ধিত অংশ সুদ। সুদ হলো ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূল অর্থের সঙ্গে প্রদত্ত অতিরিক্ত অর্থ।

সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য আছে। সুদে লভ্যাংশ নির্দিষ্ট, মুনাফায় অনির্দিষ্ট। তাই মুনাফা ঝুঁকি বহনের পুরস্কার। সুদে ক্ষতির আশঙ্কা নেই, আর মুনাফায় ঝুঁকি থাকে। সুদ সময়ের বিপরীতে অতিরিক্ত। আর মুনাফা কাজের বিপরীতে অর্জিত। সুদের সম্পর্ক ঋণ ও সময়ের সঙ্গে। আর মুনাফার সম্পর্ক বেচাকেনার সঙ্গে।

সুদ অনেক সময় চক্রবৃদ্ধি আকারে হয়। মুনাফা এর বিপরীত। চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা অর্জিত হয় না। সুদ ঋণের চুক্তি। আর মুনাফা আর্থিক সম্পদের বিনিময়। মুনাফা হলো ব্যবসানির্ভর, আর সুদ আর্থিক লেনদেন ভিত্তিক। সুদ পূর্বনির্ধারিত, অন্যদিকে মুনাফা অর্জিত হয় পরে। সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে না, পক্ষান্তরে মুনাফা উদ্যোক্তা ও পুঁজির জোগানদাতার সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ফল। মুনাফা উদ্যোক্তার পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের ফল; কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণ করে না, অর্থ ধার দেয় মাত্র।

ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফা অর্জন

ব্যবসার লক্ষ্য হলো সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটানো বা মুনাফা অর্জন করা। ব্যবসার মাধ্যমে মূলধনের মুনাফা লাভ ইসলামে সম্পূর্ণরূপে জায়েজ। মহান আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীরা, তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, কিন্তু তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা করা বৈধ। (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে হালাল উপায়ে যে মুনাফা বা লাভ অর্জন করে, পবিত্র কোরআনে তাকে ‘ আল্লাহর অনুগ্রহ ’ বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত (যুদ্ধ থেকে নিরাপত্তা) ও অনুগ্রহসহ (লাভজনক ব্যবসা)। কোনো মন্দ তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৭৪)

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যেকোনো উপায়ে মুনাফা অর্জনের অবাধ সুযোগ আছে। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত মুনাফা অবৈধ বা হারাম। তবে বৈধ উপায়ে মুনাফা অর্জন করার সুযোগ আছে।

মুনাফার সীমানা ও শর্ত

শরিয়তে মুনাফা বা লাভের কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। বরং তা সাধারণ বাজারদরের আলোকে হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে শর্ত হলো—প্রথমত, তাতে কারো ওপর জুলুম করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো। কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৭০)

দ্বিতীয়ত, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাইতো বলেছেন, ক্রয়-বিক্রয় শুধু পারস্পরিক সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়। (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৮৫)

উরওয়া বারিকি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) একটি বকরি কিনে দেয়ার জন্য তাঁকে একটি দিনার দিলেন। তিনি ওই দিনার দিয়ে দুটি বকরি কিনলেন। অতঃপর এক দিনার মূল্যে একটি বকরি বিক্রি করে দিলেন এবং মহানবী (সা.)-এর খিদমতে একটি বকরি ও একটি দিনার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তা দেখে তিনি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত হওয়ার জন্য দোয়া করে দিলেন। অতঃপর তাঁর অবস্থা এমন হলো যে ব্যবসার জন্য যদি মাটিও তিনি কিনতেন, তাতেও তিনি লাভবান হতেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৬৪২)

আলোচ্য হাদিস থেকে জানা যায়, কৌশল অবলম্বন করে বৈধভাবে শতভাগ লাভ করলেও তাতে কোনো সমস্যা নেই।

সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড শায়খ বিন বাজ (রহ.) এক ফতোয়ায় বলেন, মুনাফার কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। বরং বেশি ও কম লাভ করা জায়েজ। তবে বাজারে পণ্য যদি নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট মূল্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে বিক্রেতার জন্য মানুষকে ধোঁকা দেওয়া অনুচিত। কর্তব্য হলো, মানুষকে জানিয়ে দেয়া যে এই দ্রব্য এত মূল্যে বাজারে বিদ্যমান আছে। কিন্তু আমি এই মূল্যে আমার এই পণ্যটি বিক্রি করব না। এখন ক্রেতা যদি গুণগত মান দেখে বেশি মূল্যে তা ক্রয় করতে আগ্রহী হয়, তাতে কোনো দোষ নেই। তবে বিক্রেতা বাজারদর সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করবে। আর মূল্য যদি নির্ধারিত না থাকে তাহলে সে যেকোনো মূল্যে বিক্রি করতে পারে।

মিথ্যা শপথ করে পণ্যের দাম বাড়ানো নিষিদ্ধ

অনেক সময় ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যের প্রশংসা করে মিথ্যা কথা বলে। এতে হয়তো সাময়িক লাভ হয়, কিন্তু এমন ধোঁকাপূর্ণ ব্যবসায় বরকত থাকে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মিথ্যা কসম পণ্য চালু করে দেয় বটে, কিন্তু বরকত নিশ্চিহ্ন করে দেয়। (বুখারি, হাদিস : ২০৮৭)

দালালির মাধ্যমে দাম বাড়ানো নিষিদ্ধ

দালালির মাধ্যমে দাম বাড়ানোকে আরবিতে ‘ নাজাশ ’ বলা হয়। ‘ নাজাশ ’ শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে কোনো জিনিসের অতিরিক্ত প্রশংসা করা। পরিভাষায়, ইমাম ইবনু হাজম (রহ.) বলেন, বিক্রেতা কর্তৃক জিনিস বিক্রি করার জন্য কাউকে নিযুক্ত করা, যাতে সে বেশি দাম বলে। আসলে সে তা ক্রয় করার জন্য নয়, বরং অন্যকে প্রতারিত করার জন্য এ রকম দাম বলে থাকে, যাতে ক্রেতা তার দাম শুনে আরো বেশি দাম বলে। (ইবনু হাজম, আল-মুহাল্লা বিল-আসার : ৭/৩৭২)।

ইবনু কুদামা (রহ.) বলেন, এ ধরনের বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হলো, এটি ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা ও তাকে ধোঁকা দেয়ার শামিল। (আল-মুগনি : ৬/৩০৪-৫) । ইবনে উমর (রা.) বলেন, নবী (সা.) প্রতারণামূলক দালালি থেকে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২১৪২)

ইসলামে মজুদদারি নিষিদ্ধ

ইসলামে মজুদদারি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুজদদারির উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি মুনাফা অর্জন। মামার ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাপাচারী লোক ছাড়া কেউ গুদামজাত করে না। (মুসলিম, হাদিস : ৪০১৫)

পরিশেষে, মুনাফাখোরি, মজুদদারি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—একটি অন্যটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিকল্প নেই।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!