জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দায় কি সাংবাদিকেরা এড়াতে পারে ?

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
  • 43 পাঠক

এ কে এম জাকারিয়া । ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

জুলাই-আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতার অনেক ভিডিও বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখেছি। অনেক ভিডিওতে এমন নিষ্ঠুরতার দৃশ্য আছে যে তা সহ্য করা যায় না। এসব ভিডিও দেখার সময় অনেককেই চোখ ঢাকতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি। পুলিশের পাশাপাশি দলের গুন্ডারাও শামিল ছিল এসব অপকর্মে।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের বর্বরতার একটি প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে ছবিটি তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমেও ছবিটি দেখানো হচ্ছে।

——————————————————————–

সৌজন্যে : প্রথম আলো

——————————————————————–

শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আগে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ঘণ্টা দেড়েক সময়ের মধ্যে কী ঘটেছিল, তার প্রামাণ্য দলিল এ ছবি। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ফুটেজগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বিচার–বিশ্লেষণের পর ছবিটি তৈরি করেছে তারা। ছবিতে দেখা গেছে কীভাবে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে পুলিশ।

দেশের অনেক জায়গাতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনার ভিডিও সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ অনেকেই করছেন নিশ্চয়। জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞ নিয়ে নতুন নতুন আরও প্রামাণ্যচিত্র সামনে আমরা দেখতে পাব আশা করি। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের জন্যও তথ্যপ্রমাণ হিসেবে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ‘ অসংখ্য ডিজিটাল এভিডেন্স ’ সংগ্রহ করার কথা নিশ্চিত করেছেন।

—————————————————————————————

গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে অনেক সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে পতিত সরকারের সমর্থনে ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। অনেকের সাংবাদিকতার শুরুই এই ‘ পোষা ’ সাংবাদিকতার অপচর্চার মধ্য দিয়ে। আবার এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অনেকেই সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা জারি রাখার চেষ্টা করে গেছেন। একটি রক্তঝরা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। অন্য সবকিছুর মতো গণমাধ্যম নিয়েও তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা।

———————————————————————————-

পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও জানেন, আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের দলীয় ক্যাডারে পরিণত হওয়া কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে তাঁরা কত বড় অন্যায় ও অপকর্ম করেছেন। যে কারণে দেশের সব থানা থেকে পুলিশ বাহিনীর লোকজন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। পুলিশ ও র‍্যাবপ্রধান সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানে তাঁদের ভূমিকার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

তবে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মূল দায় যাদের, সেই আওয়ামী লীগ বা তাদের নেতৃত্বের কোনো বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার, দলের লোকজন এবং তাঁদের লুটপাটের সহযোগী বিভিন্ন পেশার অনেকে আটক হয়েছেন। আবার অনেকে দেশে-বিদেশে পালিয়ে আছেন। বিশেষ করে যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে শত শত মানুষ খুনের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, কোনো অনুশোচনার কথাও শোনা যাচ্ছে না। মানুষ খুনের এসব ভিডিও বা তথ্যপ্রমাণ তাঁদের মনে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, কে জানে! তাঁদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা বা মনোবিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

—————————————————————————————–

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভুল, অপকর্ম বা অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়ার নজির নেই। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে তার ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। বোঝা যায়, আওয়ামী লীগও সেই একই পথ ধরেছে। তারা ক্ষমা চাইবে না, নিজেদের অপকর্মের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাবে।

—————————————————————————————–

জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগ চলছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যাঁরা সরাসরি এ গণহত্যায় ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরাই সম্ভবত বিচারের আওতায় আসবেন। তবে সেটা কতটুকু ও কোন মাত্রায় নিশ্চিত করা যাবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে।

২.

সাংবাদিকতা করি বলে অনেকেই জানতে চান, দেশে ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসার পেছনে তো সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন করেন, এই যে গণহত্যা হলো, এর কোনো দায় কি সাংবাদিকদের নেই ? এটা স্বীকার করতে কোনো সমস্যা নেই যে গত ১৬ বছর দেশে যে শাসন কায়েম হয়েছিল, তার শিকড় গাড়তে ও ডালপালা ছড়াতে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাঁরা এই শাসনের পক্ষে সম্মতি তৈরির কাজ করে গেছেন কোনো রাখঢাক ছাড়াই।

এসব করার বিনিময়ে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, ব্যবসা বাগিয়েছেন, তদবির–বাণিজ্য করে পয়সা কামিয়েছেন। এভাবে একপর্যায়ে তাঁরা ক্ষমতাকাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছেন। ক্ষমতা রক্ষার দায় থেকে তখন তাঁরা এমনকি যাঁরা পেশাদার ও সাহসী সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের গলা চেপে ধরতেও কসুর করেননি।

—————————————————————————————–

গণহত্যা যখন চলছিল, তখনো এই সাংবাদিকদের সেই ভূমিকায় দেখা গেছে। পুলিশ যখন মারমুখী, পুলিশ যখন নির্বিচার মানুষ হত্যা করছে, তখনো তাঁরা পুরো সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রে হাজির থেকেছেন। একটি দৃষ্টান্ত দিই: আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৬ জুলাই আর ২৪ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসেছিলেন দেশের ‘ শীর্ষস্থানীয় ’ সাংবাদিকেরা।

—————————————————————————————–

তাঁরা দেশজুড়ে ‘ নাশকতা ও নৃশংসতার ’ ঘটনায় কোনো অপরাধীকে ছাড় না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সেই সাংবাদিকেরা সেদিন আরও নিশ্চিত করেছিলেন, তাঁরা শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন এবং তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার ‘মনোবল’ ধরে রাখতে তাঁরা কি শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেননি ? তাঁরা দায় এড়াবেন কীভাবে ?

৩.

রুয়ান্ডার গণহত্যার কথা আমাদের অনেকেরই জানা। ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল শুরু হওয়া এ গণহত্যায় সংখ্যাগুরু হুতিদের হাতে ১০০ দিনে প্রায় ১০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। তাদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের লোক। এই সহিংসতা উসকে দেওয়া ও দীর্ঘায়িত করার পেছনে গণমাধ্যমের বিশেষ দায় রয়েছে।

গণহত্যা ঘটানোর আগে হুতি চরমপন্থীদের নানা উদ্যোগের মধ্যে একটি ছিল রেডিও স্টেশন স্থাপন করা। আরটিএলএম নামের রেডিও স্টেশনটি তুতসিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও সহিংসতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এই রেডিওর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে কাঙ্গুরা নামের একটি সংবাদপত্র।

————————————————————————

রুয়ান্ডার গণহত্যায় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে অনেক গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। দেখা গেছে, হুতি চরমপন্থীদের পরিচালিত রেডিওটি তুতসিদের হত্যা করতে উৎসাহিত করেছে এবং হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে তুতসিদের হত্যা করা জরুরি—এমন একটি প্রচারণা তারা চালিয়ে গেছে। গবেষক, যুদ্ধ সাংবাদিক ও কূটনীতিক সামান্থা পাওয়ারের মন্তব্য, তুতসিদের হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের অনেকের এক হাতে ছিল দা ও অন্য হাতে রেডিও।

————————————————————————

আরেক বিশ্লেষক মেল ম্যাকনাল্টি রেডিওটিকে (আরটিএলএম) গণহত্যার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, রেডিওর প্রচারণা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে হুতিরা মনে করেছে, তুতসিদের হত্যা করা তাদের টিকে থাকার জন্য জরুরি। বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন ‘আর্টিকেল ১৯’–এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আরটিএলএম ছিল গণহত্যা বাস্তবায়নের একটি সুস্পষ্ট হাতিয়ার।

২০০৩ সালে রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আরটিএলএম রেডিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফার্দিনান্দ নাহিমানা, নির্বাহী পরিচালক জ্যঁ-বসকো বারায়গওয়িজা এবং কাঙ্গুরা পত্রিকার সম্পাদক হাসান এনগেজেকে ঘৃণা উসকে দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। রেডিও সম্প্রচার ও সংবাদপত্রের ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনাগুলোকে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রুয়ান্ডার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে কি ?

৪.

গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে অনেক সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে পতিত সরকারের সমর্থনে ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। অনেকের সাংবাদিকতার শুরুই এই ‘পোষা’ সাংবাদিকতার অপচর্চার মধ্য দিয়ে। আবার এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অনেকেই সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা জারি রাখার চেষ্টা করে গেছেন।

—————————————————————————————–

একটি রক্তঝরা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। অন্য সবকিছুর মতো গণমাধ্যম নিয়েও তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা। কিন্তু গত ১৬ বছরের পোষা সাংবাদিকতার অভ্যাস বা চর্চা থেকে কি দেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বের হয়ে আসতে পারবে ?

—————————————————————————————–

এখানে পরিবর্তন চাইলে ১৬ বছর ধরে সংবাদমাধ্যমকে খাঁচায় পুরে ফেলতে কী কী কৌশল নেওয়া হয়েছিল, সাংবাদিকদের কীভাবে পোষা সাংবাদিকে পরিণত করা হয়েছিল, সেগুলো চিহ্নিত করা দরকার।

রুয়ান্ডার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় সাংবাদিকদের দায়ের বিষয়টিরও একটি নিষ্পত্তি দরকার। গণমাধ্যম সংস্কারের পথ এভাবেই তৈরি হতে পারে।

● এ কে এম জাকারিয়া, প্রথম আলোর উপসম্পাদক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!