রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে সম্মানহানি করা থেকে বিরত থাকে, আল্লহ তায়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেন, (আহমাদ)। আবার কেউ অন্যায়ভাবে তার মুসলমান ভাইয়ের মান-ইজ্জত খাটো করলে তার সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, যদি ‘কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে এমন স্থানে লাঞ্ছিত করে, যেখানে তার মানহানি ঘটে এবং সর্বদা খাটো করা হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে লাঞ্ছিত করবেন, যেখানে তার সাহায্যপ্রাপ্তির আশা ছিল, (আবু দাউদ)। দোষারোপ করা, কারও দুর্নাম করা তো দূরের কথা, কারও সম্পর্কে কিছু প্রমাণ ছাড়া বলাও যাবে না। অহেতুক মানুষকে দোষারোপ করা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, মুমিনদের প্রতি তোমরা ভালো ধারণা পোষণ করবে। অনুমান করেও কিছু বলা যাবে না। কারণ আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ, (সুরা হুজুরাত, ১২)।
কিছু পাপের কোনো কাফফারা হয় না। কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া তেমনই একটি পাপ। রাসুল (সা.) বলেছেন, পাঁচটি পাপ এমন, যার কাফফারা নেই। তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো, কোনো মুমিনকে অপবাদ দেওয়া, (আহমদ)। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে, যা থেকে সে মুক্ত। আল্লাহ তাকে “রাদগাতুল খাবাল” নামক জাহান্নামের গর্তে বাসস্থান করে দেবেন, যতক্ষণ সে অপবাদ থেকে ফিরে না আসে, (আবু দাউদ)। তাই কথা বলার সময় সতর্ক থাকা দরকার। কম কথা বলা উত্তম। নবীজি (সা.) জিহ্বাকে সংযত রাখতে বলেছেন।
স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে, অন্যের কান কথায় প্ররোচিত হয়ে কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া জঘন্য অপরাধ। কারো সম্মানহানি করার অধিকার অন্যের নেই। ইসলামে মিথ্যা দোষারোপের সুযোগ নেই। এটা ঘৃণিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক, (সূরা হাজ্জ, ২৩)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে, (সুরা আহযাব, ৮৫)।
হযরত মূসা (আ:) নবুওয়ত লাভের পূর্ব হতেই অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ ও সত্যপ্রিয় ছিলেন। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল সর্বদাই বলিষ্ঠ। বনী ইসরাইলদেরকে ফেরাউনের গোলামী হতে রক্ষা করার জন্যে তিনি প্রাণপন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তদুপরি তাদেরকে দীনের ছায়াতলে আবদ্ধ করতে সক্ষম হননি। তার দাওয়াতে সমপ্রদায়ের কতিপয় যুবকই সাড়া দিয়েছিল। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘ফেরাউন ও তার সভাসদবৃন্দের নির্যাতনের ভয়ে তার সমপ্রদায়ের একদল যুবক ছাড়া কেউ তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেনি’।
অপরদিকে ফেরাউন সমপ্রদায় তার দাওয়াতকে স্তব্দ করে দেয়ার জন্যে হীন কুট-কৌশল অবলম্বন করেছিল। তারা স্বয়ং দাঈর ব্যক্তিগত বিষয়ে বিভিন্ন অপবাদের আশ্রয় নেয়। তাদের দৃষ্টিতে মূসা (আ) একজন জাদুকর, বদ্ধপাগল, জাদুগ্রস্থ, পূর্বতন ধর্মের বিকৃতকারী ও নব্য ধর্মের প্রবর্তক। মূলত: সাধারণ মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং তার দাওয়াতকে বিফল করতে তারা এ ধরনের কুট-কৌশলের পায়তারা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূসা (আ:) তাদের উপর বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তাদের মনগড়া মতাদর্শ পরাজিত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, চরিত্রহীনা নারী চরিত্রহীন পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রহীন পুরুষ চরিত্রহীনা নারীর যোগ্য। চরিত্রবতী নারী চরিত্রবান পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রবান পুরুষ চরিত্রবতী নারীর যোগ্য। কোন মিথ্যা অপবাদই চরিত্রবানদের কলঙ্কিত করতে পারে না। এদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবনোপকরণ, (সূরা নূর, ২৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, মুনাফেক, রুগ্নমনা ও মিথ্যা গুজব রটনাকারীরা শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজ থেকে বিরত না হলে আমি ওদের ওপর তোমাকে কর্তৃত্ব দান করব। তারপর (হে নবী!) খুব অল্প সময়ই ওরা এই নগরে তোমার প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে পারবে। অভিশপ্ত অবস্থায় ওদের যেখানে পাওয়া যাবে, পাকড়াও ও বিনাশ করা হবে, (সূরা আহজাব, ৬১)।
অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা এক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের সুসম্পর্কে চিড় ধরায়। সামাজিক ও জাতীয় ঐক্যের জন্যও প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে এ ধরনের প্রবণতা। যে কারণে ইসলামে অপবাদ দেওয়ার প্রবণতাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিতে অপর মুসলমানকে অপবাদ দেওয়া কবিরা গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেন, যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে, (সূরা আহযাব, ৫৮)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, তোমরা একজন আরেকজনের দোষ তালাশ করে বেড়িও না এবং কারও অগোচরে গীবত কর না। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন সেই হবে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় ব্যক্তি, যার অশ্লীল কথা শোনার ভয়ে মানুষ তার কাছ থেকে দূরে থাকে বা তার সংশ্রব ত্যাগ করে, (বুখারি)।
রসুল (সা.) আরও বলেন, ওহে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর থেকে অনুদারতা উঠিয়ে দিয়েছেন। তবে যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের ইজ্জত সম্মান নিয়ে যাচ্ছেতাই করে, তার ব্যাপার স্বতন্ত্র। সে অনুদারতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে অথবা ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন- এক মুসলমানের জন্য আরেক মুসলমানের রক্ত ঝরানো, সম্পদ ও সম্ভ্রমহানি করা হারাম, (মুসলিম, ৪৬৫০)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। কেউ কারও প্রতি অত্যাচার চালায় না, একজন আরেকজনকে অসম্মান, অশ্রদ্ধা করে না। কোনো মুসলমানের জন্য এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর নেই, সে তার মুসলিম ভাইকে ঘৃণা বা অশ্রদ্ধা করবে, (মুসলিম, ৪৬৫০)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রসুলের (সা.) সমীপে অভিযোগ এলো- অমুক স্ত্রীলোক সারা রাত নামাজ পড়ে এবং প্রতিদিন রোজা রাখে; কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদের (তিক্ত কথায়) দুঃখ দেয়, রাসুল (সা.) বললেন, তাতে কল্যাণ নেই, সে দোজখে যাবে, (আহমাদ)।
ইসলামে দোষারোপ করা তো দূরের কথা, কারো সম্পর্কে কিছু প্রমাণ ছাড়া বলতেও নিষেধ করা হয়েছে। কেননা মিথ্যা অপবাদে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, মুমিনদের প্রতি তোমরা ভালো ধারণা পোষণ করবে। অনুমান করেও কিছু বলা যাবে না। কারণ আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ অনুমান অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, (সুরা হুজরাত, ১২)।
কাউকে কোনো অপরাধে লিপ্ত দেখলে তাকে বিচারকের নিকট সোপর্দ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে বিচার ছাড়া কেউ শাস্তি দিতে পারেন না। এই প্রক্রিয়ার বাইরে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধান বিচারপতিও কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না। উমর (রা.) আব্দুর রাহমান ইবনু আউফকে (রা.) বলেন, আপনি শাসক থাকা অবস্থায় যদি কাউকে ব্যভিচারের অপরাধে বা চুরির অপরাধরত দেখতে পান, তাহলে তার বিচারের বিধান কী? (নিজের দেখাতেই কি বিচার করতে পারবেন?) আব্দুর রাহমান (রা.) বলেন, “আপনার সাক্ষ্যও একজন সাধারণ মুসলিমের সাক্ষ্যের সমান”। উমর (রা.)বলেন, “আপনি সঠিক বলেছেন”।
অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান নিজের হাতে বিচার তুলে নিতে পারবেন না। এমনকি তার সাক্ষ্যেরও অতিরিক্ত কোনো মূল্য নেই। রাষ্ট্রপ্রধানের একার সাক্ষ্যে কোনো বিচার হবে না। বিধিমোতাবেক দুইজন বা চারজন সাক্ষীর কমে বিচারক কারো বিচার করতে পারবেন না।
অন্য এক ঘটনায় উমর (রা.) রাত্রে মদীনায় ঘোরাফেরা করার সময় একব্যক্তিকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান। তিনি পরদিন সকালে সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাউকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান তাহলে তিনি কি শাস্তি প্রদান করতে পারবেন? তখন আলী (রা.) বলেন, কখনোই না, আপনি ছাড়া আরো তিনজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী যদি অপরাধের সাক্ষ্য না দেয় তাহলে আপনার উপরে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে।
ইসলাম অপবাদ রটনাকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কোন পূতচরিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কেউ (ব্যভিচারের) অপবাদ দিয়ে যদি চার জন সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপবাদ রটনাকারীকে শাস্তি হিসেবে ৮০ বেত মারবে। আর কোনদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না, এরা সত্যত্যাগী’ (সূরা নূর, ৪)।
তাই কারো সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমাদের সর্তক থাকা উচিত। অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে কষ্ট দেয়া বা সম্মানহানিকর পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা ইসলামের অপরিহার্য দাবি।
লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা
Leave a Reply