———————————–
মানুষের কাছে তার অস্তিত্ব মহান আল্লাহর আমানত। যথাসম্ভব নিজের হেফাজত ওয়াজিব। তাই সর্ব প্রথম নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করাও ওয়াজিব। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রথমে তুমি নিজের জন্য ব্যয় করো।’ (নাসায়ি, হাদিস : ২৫৪৬)
স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
স্ত্রী গরিব হোক বা ধনী। অসুস্থ হোক সুস্থ। বৃদ্ধা হোক বা যুবতী—সর্বাবস্থায় স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। এমনকি স্বামীর অনুমতিক্রমে স্ত্রী তার বাবার বাড়ি থাকলেও ভরণ-পোষণের অধিকারী হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তোমাদের ওপর। তোমরা তা স্বাভাবিকভাবে আদায় করবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৯০৫)
তবে স্বামীর অবাধ্য হয়ে স্ত্রী পিত্রালয়ে বা অন্য কোথাও চলে গেলে ভরণ-পোষণের অধিকারী হবে না। স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না করে স্বামী নিরুদ্দেশ হলে—স্বামীর সামর্থ্যবান পিতা (শ্বশুর) পুত্রবধূর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবেন।
ভরণ-পোষণের পরিমাণ
স্বামী ভরণ-পোষণ দেবে তার সামর্থ্য ও স্ত্রীর খান্দানের অবস্থা অনুযায়ী। ইরশাদ হয়েছে, ‘সচ্ছল ব্যক্তি যেন নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে। আর যার জীবিকা সীমিত সে যেন আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ ‘যা দিয়েছেন’ তার বেশি ভার কারো ওপর দেন না। আর আল্লাহ শিগগিরই দান করবেন অসচ্ছলতার পর সচ্ছলতা।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৭)
তবে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিক খোরপোষে কার্পণ্য করা স্বামীর জন্য জায়েজ নয়। তেমনি স্ত্রীর জন্যও স্বামীর সামর্থ্যের অধিক বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খোরপোষ দাবি করা বৈধ নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান, তোমাদের ওপর তাদের অধিকার এই যে খোরপোষের বিষয়ে তাদের প্রতি সদাচার করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১৬৩)
সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার ওপর। পুত্রের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত। আর কন্যার ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। (আদ্দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার : ৩/৬১২)
আর পঙ্গু, অক্ষম, পাগল এবং মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানের ক্ষেত্রে সব সময়ের জন্য। তবে সন্তানদের মালিকানায় সম্পত্তি থাকলে পিতা তা থেকে তাদের জন্য খরচ করতে পারবেন। পিতা অক্ষম হলে, আর দাদা, মা, মামা অথবা চাচা সক্ষম হলে—তারা ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তী সময়ে পিতা সক্ষম হলে তাদের খরচ ফিরিয়ে দেবেন। (কামুসুল ফিকহ : ৫/২১২)
কন্যাসন্তান সাবালক হলেও তাকে উপার্জনে বাধ্য করার অবকাশ পিতার নেই। তবে কন্যা যদি পর্দায় থেকে সেলাই ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জন করে তাহলে তার ভরণ-পোষণ নিজের জিম্মায় থাকবে। তা যথেষ্ট না হলে বাকিটুকু পিতার জিম্মায় ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৬১২)
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার দুধের ব্যবস্থা করা পিতার দায়িত্ব। অনিবার্য কারণে মা যদি সন্তানকে বুকের দুধ দিতে না পারেন তাহলে পিতাকে দুধ বা অন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
পিতা উপার্জন করতে অক্ষম বা উপার্জনক্ষম কিন্তু উপার্জন করেন না—এ অবস্থায় মাতা-পিতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সচ্ছল সন্তানের ওপর ওয়াজিব। তবে সন্তান অসচ্ছল হলে অভাবী ও অক্ষম মাতা-পিতাকে নিজের পরিবারে শামিল করে নেওয়া উচিত। কারণ গোটা পরিবারের খাদ্য বস্ত্রে এক-দুজন শামিল করা অসম্ভব নয়। (আলমুফাসসাল : ১০/১৯৫)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার (কিছু) সম্পদ আছে এবং পিতা আছেন। কিন্তু পিতা আমার সব সম্পদ নিয়ে যেতে চান! তখন নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ দুটোই তোমার পিতার। তোমাদের সন্তানরা হচ্ছে তোমাদের উত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা নিজ সন্তানের উপার্জন ভোগ করো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৩০)
যার ওপর জাকাত ফরজ সে ইসলামের দৃষ্টিতে সচ্ছল বা সামর্থ্যবান। তাকে দরিদ্র মাতা-পিতার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/৫৬৪)
একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা থাকলে সচ্ছল বা উপার্জনক্ষম সন্তানের সবার ওপর অভাবী মাতা-পিতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তাবে।
দাদা-দাদি, নানা-নানিও পিতা-মাতার মতোই। সুতরাং প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের ভরণ-পোষণের ভার পৌত্র-পৌত্রি ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের ওপর অর্পিত হবে। (মাবসুত সারাখসি : ৫/২২২)
মাতা-পিতা অমুসমিল হলেও প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁদের ভরণ-পোষণের ভার সন্তানকে বহন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৩/৪৪৯)
এমনিভাবে পিতা মাজুর হলে সৎ মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও সামর্থ্যবান সন্তানদের ওপর থাকবে।
ভাই-বোন ও অন্য আত্মীয়দের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাই-বোন ও রক্তসম্পর্কীয় মাহরাম আত্মীয়ের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা ওয়াজিব হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মা-বাবার সেবা করবে। ভাই-বোনের সেবা করবে। এই হক আদায় করা ও আত্মীয়তার দাবি পূরণ করা অপরিহার্য।’ (আবু দাউদ : ৫/৩৫১)
গরিব আত্মীয়কে দানে দ্বিগুণ সাওয়াব
গরিব আত্মীয়কে দানে রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। নবীজি (সা.) বলেছেন, অভাবীকে দান করা সদকা। আর বংশীয় আত্মীয়কে দান করা সদকা ও আত্মীয়তার হক আদায়। (তিরমিজি, হাদিস : ৬৫৮)
আবার তারা যদি এতিম, বিধবা বা প্রতিবন্ধী ইত্যাদি হয় তাহলে আরো অনেক বেশি সওয়াব।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
Leave a Reply