নাটকের নামে যা হচ্ছে!

  • আপডেট সময় বুধবার, জুলাই ২৮, ২০২১
  • 865 পাঠক
বিনোদন ডেস্ক
—————-

সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন মাধ্যমে নাটক প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ায় টিভি নাটক আবেদন হারাচ্ছে। একই রকম গল্প, ঘুরেফিরে একই অভিনেতা- অভিনেত্রী, বাংলা ভাষার বাজে ব্যবহার, অপসংস্কৃতিকে নানাভাবে ইন্ধন, সবমিলিয়ে নাটকের নামে এসব কী হচ্ছে? 
একসময় টিভি নাটক প্রচারের একমাত্র মাধ্যম ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সে সময় নাটকের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এ ছাড়া যাঁরা নাটক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় মেধাবী এবং পরীক্ষিত। সময়ের বিবর্তনে একসময় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফরমগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে শত শত নাটক। আর এসব নাটক নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সম্প্রতি আফরান নিশো ও মেহজাবীন অভিনীত ‘ঘটনা সত্য’ শিরোনামের নাটকটির শেষ অংশের একটি বার্তা নিয়েই সমালোচনা শুরু হয়েছে মিডিয়ায়। অবশেষে প্রতিবাদের মুখে নাটকটি ইউটিউব থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নির্মাতা রুবেল হোসেন ও প্রযোজক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, নাটকটিতে বিশেষ শিশুদের বিষয়ে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। অনভিপ্রেত এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন নাটকটির পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনাটির দায় কে নেবে? নাট্যকার যখন নাটকের গল্প লিখেন, তাঁর মাথায় কি ছিল না, তিনি একটি সামাজিক কুসংস্কারের ইন্ধন দিচ্ছেন। পরিচালক যখন নাটকটি পরিচালনা করছিলেন, তিনি কি জানেন না, তিনি কি নির্মাণ করছেন। নাটকে অভিনয়ের আগে অভিনেতা- অভিনেত্রীকে স্ক্রিপ্ট দেয়া হয়। তাঁদের চোখেও কি এ বিষয়টি একবারের জন্য পড়েনি। টিভি চ্যানেলে নাটক প্রচারের আগে তা প্রভিউ করা হয়। তাদের চোখও কি এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।

আর ইউটিউবের কথা না হয় বাদই দিলাম। একটি নাটক রচনা করা থেকে দর্শকের সামনে আসা পর্যন্ত অনেক ধাপ পার করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো এতগুলো ধাপ পার হলো, আর বিষয়টি কারো চোখে পড়েনি। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিল্পী ও কলাকুশলীরা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।

Bangladesh Pratidin 

এ প্রসঙ্গে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ‘আমার মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তা হলো, ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটির মতো এমন একটি নাটক বানানোর স্পর্ধা মানুষ পায় কি করে। অটিস্টিক একটি শিশু এবং মা-বাবার কী ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যান, এটা এই নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানেন না, তা আমি বিশ্বাস করি না। বিশেষ করে এই নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কথা বলছি।

টিভি চ্যানেল, এজেন্সি, প্রযোজক, নির্মাতা- এদের সবার কাছে প্রশ্ন এমন একটি নাটক বানানোর স্পর্ধা পায় কী করে? অবশ্যই এটা আসে তারকা অভিনেতাদের কাছ থেকে। বিষয়টি নিয়ে এফটিপিওর চেয়ারম্যান অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক মামুনুর রশীদ বলছেন, ‘এটি খুব দায়িত্বহীন কাজ হয়েছে।

নাট্যকাররা না জেনেশুনেই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত, মেডিকেলের বিষয়টিকে যে এভাবে তুলে ধরেছেন তা ঘোরতর অন্যায়। আমার নিজেরও নাতি আছে; স্পেশাল চাইল্ড। তাঁরা একদমই দায়িত্বহীন কাজ করেছেন। তাঁরা নাটকটা তুলে নিয়েছেন। তারপরও আমরা আমাদের দিক থেকে খুব স্ট্রং রিঅ্যাকশন দিয়েছি।’

অন্যদিকে টেলিভিশনকে বলা হয় জাতীয় জীবনের দর্পণস্বরূপ। এই দর্পণের মাধ্যমেই আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছি। একটা সময় এই টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকই বাংলা ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলতে পারা ও শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বহুব্রীহি, অয়োময়, কোন কাননের ফুল, কোথাও কেউ নেই, সংশপ্তক, আজ রবিবারসহ আরও অনেক নাটকে অভিনেতাদের অভিনয়, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি এমনভাবে প্রতিফলিত হতো, তা দেখলেই বোঝা যেত, নাট্যকার দর্শকদের কাছে এর শিক্ষণীয় বিভিন্ন বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কতখানি চিন্তিত।

 

বর্তমানে নাটকে ভাষার বিকৃতি অনেকাংশে ভাঁড়ামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। খুব কম নাটকেই দেখা যায় সঠিক বাংলা ভাষার ব্যবহার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে শুদ্ধ ভাষাকে মিলিয়ে নতুন এক ধরনের ভাষা তৈরি করে কথা বলছে একটি দল। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মনে করে, এই নব্য বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা নাকি আধুনিকতা।

এখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে নাটক দেখতে বসে ক্রমেই বিব্রত হন বাবা-মা। সন্তানের সঙ্গে টিভি সেটের সামনে বসতে ভয় পান। হঠাৎ করে সামনে চলে আসে নাটকের অশ্লীল সংলাপ ও অশ্লীল দৃশ্য, যাতে বিব্রত সবাই। পাশাপাশি আধুনিক ট্রেন্ডের নামে অভিনয়শিল্পীরা যেসব কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরে থাকেন, সত্যিই অবাক করার মতো! একটা সময়ে নাটকের ভাষা যেমন ছিল শুদ্ধ ও সাবলীল, তেমনি ছিল রুচিশীল পোশাকও। কিন্তু দিন দিন তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

কেউ বলছেন, জাতীয় গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনে ভাষার একটি মান বজায় রাখা প্রয়োজন; আবার কেউ বলছেন আঞ্চলিক ও কথ্য ভাষাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রবীণ অভিনেতা ড. ইনামুল হক টিভি নাটকে কথ্য ভাষার ব্যবহারকে ভাষার বিকৃতি হিসেবেই দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাংলা ভাষার একটা প্রমিত রূপ রয়েছে, যা সবারই রপ্ত করা প্রয়োজন।’

আবুল হায়াত বলেন, ‘টিভি নাটকে ভাষার বিকৃতি আমি মোটেও ভালোভাবে দেখছি না। এ বিষয়টিতে আমি খুবই আহত। আমাদের বাংলা ভাষার একটা প্রমিত রূপ রয়েছে, যা সবারই রপ্ত করা দরকার। আঞ্চলিক ভাষায় আমরা নাটক করতেই পারি কিন্তু সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাও সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

কিন্তু টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও আঞ্চলিকতা টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক। সে কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ভাঁড়ামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ফলে নাটক হারাচ্ছে তার দর্শক।’

সারা যাকের বলেন, ‘আমাদের মনে রাখা উচিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে যা-ই করি না কেন, সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত। আমরা যখন কোনো ভাষা উচ্চারণ করতে যাই, তখন সে ভাষার অভিধানে যেভাবে রয়েছে সেভাবেই তা করা উচিত।

যেমন, যদি কেউ ঢাকার আদি ভাষায় কোনো কিছু রচনা করতে চান, তাহলে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা করে লেখা উচিত। নাটক-সিনেমার সংলাপ লিখতে গেলেও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আমি মনে করি, নাটক-সিনেমায় যাঁরা বাংলা ভাষাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন, তাঁরা ঠিক করছেন না। ভুল পথেই হাঁটছেন তাঁরা।’

আফসানা মিমি বলেন,, ‘দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্ত ঝরিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি আমরা। তাই নাটকে নিজের ভাষা বিকৃত করে উপস্থাপন করায় আমাদের ভাষার অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে বলেই আমি মনে করি। আমরা নাটকে শুদ্ধ বাংলায় সংলাপের ব্যবহার শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যদি আঞ্চলিক কোনো নাটক হয় সেটা ভিন্ন কথা।

বিনা কারণে টিভি নাটকে বাংলা ভাষার উচ্চারণে অশুদ্ধতা, অসংলগ্নতা একেবারেই সমর্থন করি না। আমি মনে করি, আমাদের খুব দ্রুত ভাষা বিকৃতির এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত। তা না হলে এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

আমাদের নাট্য নির্মাতা, প্রকাশক, চ্যানেল- সবাই এখন ভিউর পেছনে ছুটছেন। অথচ সেদিক দিয়ে অনন্য উদাহরণ একজন হানিফ সংকেত। হোক সেটা নাটক, ‘ইত্যাদি’ বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান। সবসময়ই থাকে বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক বার্তা। একই সঙ্গে দর্শকনন্দিত হয়ে এটাই প্রমাণ করেন তিনি বারবার, যে মেধা থাকলে তার সঠিক প্রয়োগে দর্শককে মেসেজের সঙ্গে নির্মল বিনোদনও দেয়া সম্ভব।

এবারের ঈদুল আজহার দিন এটিএন বাংলায় প্রচারিত নাটক ‘যুগের হুজুগে’-তেও দেখা গেল হানিফ সংকেতের সেই চিরচেনা মুনশিয়ানা। শুধু এবারের ঈদের নাটক নয়, তাঁর নির্মিত প্রতিটি নাটকেরই ছিল সুন্দর নাম আর শিক্ষামূলক, যা আমাদের বর্তমান সামাজের জন্য প্রয়োজন। অস্থির নাটকের জোয়ারে হানিফ সংকেতের নাটক এখন স্বস্তির গল্প।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!