ড. মুফতি হুমায়ুন কবির
———————
মুহাম্মদ নামটি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় নাম। এমনকি তা অমুসলিমদের কাছেও প্রিয়। যদিও কেউ কেউ ঈর্ষার কারণে বিভিন্ন আবুল তাবুল কথা ব্যক্ত করে থাকে। প্যারেন্টিং ও প্রেগনেন্সি ওয়েবসাইট বেবি সেন্টার এক জরিপে দাবি করেছে যে যুক্তরাজ্যে ছেলেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে ‘মুহাম্মদ’। (দ্য গার্ডিয়ানের সূত্রে ঢাকা টাইমস, ৩-১২-১৪)
ইসলাম ধর্মেও এ মহিমান্বিত নামের বিশেষ গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সাধারণত মুসলমানদের নামের শুরুতে ‘মুহাম্মদ’ লেখার রীতি দীর্ঘকালের। তারা পূর্ববর্তী ব্যবহৃত শ্রী শব্দের বিপরীতে ইসলামী নাম বোঝানোর জন্য মুহাম্মদ নাম যুক্ত করার প্রবণতা চালু করেছিল। তবে নামের শুরুতে ‘মুহাম্মদ’ লেখা কোনো ধর্মীয় বিধান নয়। উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সাধারণত এ প্রচলন দেখা যায় না।
মুহাম্মদ ও আহমদ শব্দ দুটি হামদ শব্দ থেকে নির্গত। হামদ শব্দের অর্থ প্রশংসা করা। মুহাম্মদ শব্দের অর্থ অধিক প্রশংসিত। আহমদ শব্দের অর্থ দুটি হতে পারে। এক. মুহাম্মদের সমার্থক তথা অধিক প্রশংসিত। অন্য অর্থ হলো অধিক প্রশংসাকারী। যেহেতু নবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে বেশি প্রশংসিত এবং মানুষের কাছে, ফেরেশতাদের কাছে তিনি সমাদৃত আর বিভিন্ন প্রশংসিত গুণাবলি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান, তাই তাকে মুহাম্মদ ও আহমদ বলা হয়।
আবু আলী হুসাইন লিখেছেন, আলিমরা মুহাম্মদ নাম রাখার কারণে তিনটি মতামত পেশ করেন। এক. তাকে মুহাম্মদ বলার কারণ তার মধ্যে অসংখ্য দ্বিন, জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জা, শোকর, ন্যায়, দুনিয়াবিমুখতা, বিনয়, ক্ষমা, পবিত্রতা, বদান্যতা, বিরত্বের গুণ আছে। দুই. তাঁকে মুহাম্মদ বলার কারণ হলো, মানুষ তাঁর বেশি প্রশংসা করে থাকেন।
তিন. তাঁকে মুহাম্মদ বলার কারণ ফেরেশতা ও মানুষ তাঁর বেশি প্রশংসা করেন। আসমান ও জমিনবাসী তাঁর প্রশংসা করে। তাই বর্ণিত আছে যে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন আবদুল মুত্তালিব একটি উট জবেহ করলেন আর কুরাইশদের দাওয়াত করেন। তাদের অভ্যাস ছিল যখনই কোনো নবজাতক জন্মগ্রহণ করত তাকে ফজর পর্যন্ত একটি ডেগে ঢাকনা দিয়ে রাখত। তারা তা-ই করল। দেখা গেল ডেগ ভেঙে গেল।
তিনি আসমানের দিকে দেখতে রইলেন। যখন কুরাইশের অভিজাত লোক হাজির হয়ে খাবার গ্রহণ করল তারা আবদুল মুত্তালিবকে বলল, তোমার এই নাতির নাম কী রেখেছ? তিনি বলেন, মুহাম্মদ। তখন তারা বলল, এই নাম তোমার বংশে নেই। তখন তিনি বলেন, আমি ইচ্ছা করছি আসমান ও জমিনবাসী এর প্রশংসা করুক।
তা দ্বারা বোঝা যায়, সৃষ্টিজগতের প্রশংসার কারণে তার নাম মুহাম্মদ। তেমনি তিনি বহু প্রশংসিত গুণের সমষ্টির কারণে মুহাম্মদ। তেমনি ফেরেশতা ও মানুষের প্রশংসার কারণে তিনি মুহাম্মদ। (আবু আলি হুসাইন বিন আলী শাওশাবি, তানবিহুল আতশান, পৃষ্ঠা ১০৬)
আবু আবদুল্লাহ ফাকেহি লিখেন, মুহাম্মদ ও আহমদ সর্বপ্রথম আরবে অনুপ্রবেশ। এর আগে এই নামে কারো নাম রাখা হয়নি। তার মাকে স্বপ্নে বলা হলো তার নাম মুহাম্মদ রাখো ও তার নাম তাওরাতে আহমদ। (আবু আবদুল্লাহ ফাকেহি, আখবারু মক্কা ফি কাদিমিদ দাহরি ওয়া হাদিসিহি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৮৯)।
কাজি আয়াজ বলেন, মুহাম্মদ নামে প্রাচীন ইতিহাসে ছয়জন মানুষের নাম পাওয়া যায়। ইবনে খালভি বলেন, তাদের সংখ্যা তিনজন। আবুল ফজল ইবনে হাজরের মতে তাদের সংখ্যা ২০ জন। তাদের মধ্য থেকে মাত্র একজন নবী (সা.)-এর ইসলামী যুগ পেয়েছিল। তাঁর নাম মুহাম্মদ বিন বারা। যিনি সাহাবি ছিলেন। বাকিরা ইসলামী যুগ পাইনি। (ইবনে হাজর হাইতামি, আল ফতাওয়া আল হাদিসাহ, পৃষ্ঠা ২৮০)
মুহাম্মদ নাম রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার গর্ভবতী স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের নাম মুহাম্মদ রাখার সিদ্ধান্ত নেবে, আল্লাহ তাকে পুত্রসন্তান দান করবেন। আর যে ঘরে মুহাম্মদ নামের কোনো ব্যক্তি থাকবে, আল্লাহ সব সময় সে ঘরে বরকত অব্যাহত রাখবেন। (ফাজায়েলুত তাসমিয়া বি আহমদ ওয়া মুহাম্মদ)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের নাম মুহাম্মদ রেখে তাকে গালি দিয়ো না। (মুসতাদরাক হাকিম, হাদিস : ৭৭৯৫)
ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, যে ঘরেই মুহাম্মদ নামের কোনো ব্যক্তি থাকবে তাতে বরকত ছড়াতে থাকবে। (ফয়জুল কাদির : ৫/৪৫৩)
‘মুহাম্মদ’ ও ‘আহমদ’ এ দুই নামে মহানবী (সা.) গোটা সৃষ্টিজগতে পরিচিত। ‘মুহাম্মদ’ অর্থ ‘চরম প্রশংসিত’ আর ‘আহমদ’ অর্থ ‘চরম প্রশংসাকারী’। এ দুটো তাঁর সত্তাগত নাম; কিন্তু পরস্পর পরিপূরক।
আরবি ‘মিম’, ‘হা’, ‘মিম’ ও ‘দাল’-এ চারটি হরফে ‘মুহাম্মদ’ শব্দ গঠিত, যেখানে বর্ণের সংখ্যা ও ‘নুকতা’ (বিন্দু)বিহীন। ‘মুহাম্মদ’ শব্দের সিবতি গণনা অনুসারে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১৩। এতসংখ্যক রাসুল দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছেন বলে তাফসিরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ মুহাম্মদ শব্দটি চারটি স্থানে আলোচনা করেছেন।
সত্যিই পৃথিবীতে যত নাম ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোর সেরা নাম মুহাম্মদ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply