লিভ টুগেদার ও পরকীয়ার ভয়াবহ পরিণতি

  • আপডেট সময় বুধবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২১
  • 455 পাঠক

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা   

———————–
সমাজে হু হু করে বাড়ছে লিভ টুগেদার ও পরকীয়ার প্রবণতা, যা একটি পবিত্র সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে বংশধারার স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা। একে স্বাভাবিক বিষয় ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এর কারণে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসবে।
প্রতিটি মানুষের উচিত সমাজে এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী এই অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।

লিভ টুগেদার একটি ইংরেজি শব্দ। যার বাংলা অর্থ একসঙ্গে থাকা। কিন্তু পারিভাষিক দিক থেকে লিভ টুগেদার শব্দটিকে একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিয়ের আগে যুগলদের স্বামী স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকাকে লিভ টুগেদার বলে। এটি সাধারণত অবিবাহিত ছাত্র-ছাত্রী বা চাকরিজীবীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

তাদের মধ্য থেকে ধারণা, একটি মানুষের সঙ্গে আজীবন থাকার উদ্দেশ্যেই বিয়ে করা হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষটির সঙ্গে মনের মিল হবে কি না তা না থেকে বোঝা যায় না। তাই বিয়ের আগেই তারা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলে। মনের মিল হয়ে গেলে তারপর তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এমনও দেখা গেছে যে ছেলেমেয়েসহ তারা বিয়ের আসরে বসে। নাউজুবিল্লাহ!

বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে ইসলামী পরিভাষায় ‘জিনা’ (ব্যভিচার) বলা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা ইসরা/বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩২)

‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’—এই বিধান ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমিন সমাজের জন্যও প্রযোজ্য। এটি এতটাই অশ্লীল কাজ যে তা মানুষের লজ্জা-শরম ও মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়।

আবু উমামা (রা.) বলেন, এক যুবক রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। এটা শুনে চতুর্দিক থেকে লোকেরা তার দিকে তেড়ে এসে ধমক দিল এবং চুপ করতে বলল। তখন রাসুল (সা.) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলেন, বসো। যুবকটি বসলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেন, তুমি কি এটা তোমার মায়ের জন্য পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না।

তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তেমনি মানুষও তাদের মায়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না। তারপর রাসুল (সা.) বলেন, তুমি কি তোমার মেয়ের জন্য তা পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না।

তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অনুরূপভাবে মানুষ তাদের মেয়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না। তারপর রাসুল বলেন, তুমি কি তোমার বোনের জন্য সেটা পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুল বলেন, তদ্রুপ লোকেরাও তাদের বোনের জন্য তা পছন্দ করে না।

(এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ফুফু, ও খালা সম্পর্কেও অনুরূপ কথা বলেন আর যুবকটি একই জবাব দিল) এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ওপর হাত রাখলেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, তার গুনাহ ক্ষমা করে দিন, তার মনকে পবিত্র করুন এবং তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করুন।’ বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এরপর এ যুবককে কারো প্রতি তাকাতে দেখা যেত না। (মুসনাদে অহমাদ :  ৫/২৫৬, ২৫৭)

অনেকে ভাবতে পারে, কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্কে না জড়িয়ে একসঙ্গে থাকলে তা ব্যভিচারের পর্যায়ে পড়বে না বা গুনাহ হবে না। এটা ঠিক নয়। শয়তান কোনো না কোনোভাবে তাদের ব্যভিচারে লিপ্ত করবেই। শাররিক সম্পর্কে কেউ না জড়ালেও অন্তত তারা একসঙ্গে থাকার দরুন, দেখা হবে, কথা হবে, আড্ডা হবে, গান হবে। এগুলোর মধ্যেও রয়েছে ব্যভিচারের গুনাহ।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীকে) দেখা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দুই চোখের জিনা (বেগানা নারীর দিকে) তাকানো, কানের জিনা যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের জিনা আবেগ উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের জিনা (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে) স্পর্শ করা আর পায়ের জিনা ব্যভিচারের উদ্দেশে অগ্রসর হওয়া এবং মনের জিনা হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। (মেশকাত, হাদিস : ৮৬)

এরপর আশা যাক পরকীয়ার বিষয়ে। পরকীয়া সমাজে অশান্তি ও বংশের পবিত্রতা নষ্ট করার অন্যতম নীরব হাতিয়ার। এর প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যায় হাজার পরিবার। ভেঙে চুরমার হয় লাখো স্বপ্ন। সমাজের এই পচনের জন্য যেসব বিষয় দায়ী, তার মধ্যে পরকীয়া অন্যতম। আর পরকীয়া বৃদ্ধির জন্য দায়ী পর্দার বিধানে উদাসীনতা।

অথচ পর্দার বিধান ইসলামের পক্ষ থেকে সমাজব্যবস্থার এবং বিশেষভাবে উম্মতের মা-বোনদের জন্য অনেক বড় অনুগ্রহ। এই বিধানটি মূলত ইসলামের যথার্থতা, পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। পর্দা মানুষের মর্যাদার প্রতীক এবং ইফফাত ও পবিত্রতার একমাত্র উপায়।

অনেকের ধারণা, পর্দার বিধান শুধু নারীর জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। পুরুষের জন্যও পর্দা অপরিহার্য। তবে উভয়ের পর্দার ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। যে শ্রেণির জন্য যে পর্দা উপযোগী, তাকে সেভাবে পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পরকীয়ার মূল উদ্দেশ্যই থাকে জিনা (অবৈধ সম্পর্ক)। আর তা গড়ে ওঠে সাধারণত প্রতিবেশী, অফিস কলিগ, ব্যাচমিট বা সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতজনের সঙ্গে। এটি সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য এত বড় অস্ত্র যে রাসুল (সা.) একে ব্যভিচারের চেয়ে ১০ গুণ বড় অপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের ব্যভিচার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তাঁরা বলেন, হারাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তা হারাম করেছেন। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তির ১০ জন নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া জঘন্য অপরাধ। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১০২)

এই পাপ বেশির ভাগ সংঘটিত হয় পরকীয়া সম্পর্কের জেরে। তাই প্রতিটি মুমিনের জন্য আবশ্যক, এই জঘন্য অপরাধগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং পরিবার-পরিজনদের প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রাখা। মহান আল্লাহ সবাইকে এই জঘন্য অপরাধগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!