————————-
মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন তা বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায় ছিল মদিনার মুনাফিক শ্রেণি। যারা প্রকাশ্যে ঈমানের ঘোষণা দিলেও অন্তরে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত, কুফরি ধ্যান-ধারণা লালন করত। এমনকি মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী নানা অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিল।
মদিনার মুসলিমরা কোনো সংকটের মুখোমুখি হলে তারা অজুহাত সৃষ্টি করে তাদের সহযোগিতা প্রত্যাহার করত। কোরআনে মুনাফিক সম্প্রদায়ের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে।
যদি সে কল্যাণপ্রাপ্ত হয় তবে ইবাদতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে আর যদি সে পরীক্ষায় পড়ে তবে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। ইহকাল ও পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত আর এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি।’ (সুরা হজ, আয়াত : ১১)
মদিনায় হিজরতের আগে তথা মহানবী (সা.)-এর মক্কি জীবনে মুসলিম সমাজে মুনাফিক শ্রেণির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কেননা মক্কায় মুসলিমরা ছিল একটি নিপীড়িত শ্রেণি। আর মুশরিকরা ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং সেখানে কপট ইসলামী পরিচয়ের মাধ্যমে অর্জন করার মতো কিছু ছিল না, বরং ঈমানের প্রকাশ ও ইসলামের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা ছিল নিজের ওপর সমূহ বিপদ ডেকে আনার নামান্তর।
পবিত্র কোরআনে মক্কার মুসলিমদের জীবনচিত্র এভাবে ফুটে উঠেছে—‘স্মরণ কোরো যখন তোমরা ছিলে অল্প, আর দুর্বল ছিলে দেশে। আর ছিলে ভীত-সন্ত্রস্ত, না জানি তোমাদেরকে লোকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৬)
কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর যখন মুসলিম সম্প্রদায় সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্তা হয়ে উঠল, চতুর্দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল, দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে আরম্ভ করল, তখন মুসলিম সমাজে একদল স্বার্থান্বেষী মুনাফিক শ্রেণির জন্ম হলো।
যারা মুখে ইসলামের ঘোষণা দেয়, কিন্তু তাদের ভেতর বিগত দিনের লোভ, লালসা ও অবৈধ সুযোগ গ্রহণের মানসিকতা থেকে গেল। পুরনো বোধ-বিশ্বাস ও স্বভাব-চরিত্রের প্রভাব রয়ে গেল তাদের মন ও মস্তিষ্কে। ফলে তারা না পারল মুসলিমদের সঙ্গে একীভূত হতে, আর না পারল কুফরির ঘোষণা দিতে। কোরআনের ভাষায় ‘মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায়, না এদিকে আর না ওদিকে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৪৩)
মদিনার মুনাফিকদের সরদার ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল। আল্লামা ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, ‘আউস ও খাজরাজ গোত্র ইসলাম আসার আগে তাকে (আবদুল্লাহ ইবনে উবাই) ছাড়া আর কারো নেতৃত্বের ব্যাপারে একমত হতে পারছিল না। তার সম্প্রদায় রাজমুকুট হিসেবে মাথায় পরার জন্য একটি মুকুটও বানিয়ে রেখেছিল, যা সে তাদের সম্রাট হিসেবে পরবে।
এমন অবস্থায় আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)-কে এখানে পাঠালেন। এরপর তার জাতি ও সম্প্রদায় যখন তাকে ফেলে মুসলিম হয়ে গেল, তখন তার মনে কঠিন হিংসা ও বিদ্বেষ তৈরি হলো। সে অনুভব করল রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে নেতৃত্ব ও সম্মান থেকে বঞ্চিত করলেন। কিন্তু যখন সে এ-ও দেখতে পেল, তার জাতি কোনো অবস্থাতেই ইসলাম ত্যাগ করতে রাজি হবে না, তখন সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইসলামে প্রবেশ করল। কিন্তু মুনাফিকি অন্তর্জ্বালা ও হিংসা-বিদ্বেষকে আগাগোড়াই অন্তরে লুকিয়ে রাখল।’ (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২০৮)
বেশির ভাগ মুনাফিক ছিল বৃদ্ধ ও পৌঢ়। হাতে গোনা এক-দুজন ছিল যুবক। কেননা তরুণদের মধ্যে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা অধিক পরিমাণে থাকে।
অন্যদিকে বুড়োরা সাধারণত তাঁদের অভিজ্ঞতা, স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার জন্য সত্যের সামনে নত হতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ ও মেয়ে জামিলা প্রকৃতার্থেই ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদের বাবা কপটতার ওপর অবিচল থাকে। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/৩১)
মদিনার মুনাফিকরা প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও অন্তরালে এমন কোনো ষড়যন্ত্র নেই যা তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে করেনি। এমনকি তারা কোরাইশ নেতাদের পাঠানো চিঠিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার এবং মক্কার মুহাজির মুসলিমদের মদিনা থেকে বের করে দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিচক্ষণতায় যুদ্ধের দাবানল নিভে যায়।
তিনি মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে গিয়ে বলেন, ‘কোরাইশদের হুমকিতে তোমরা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছ মনে হচ্ছে। শোন, তোমরা নিজেরা নিজেদের যত ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছ, মক্কার কোরাইশরা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা কি নিজেদের সন্তান ও ভাইয়ের সঙ্গে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও?’ নবী (সা.)-এর এ কথা শোনার পর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আবদুল্লাহর সহযোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ২০১)
মহানবী (সা.)-এর কাছে মুনাফিকদের কপটতা ও শঠতা কোনো গোপন বিষয় ছিল না। তিনি নিশ্চিতভাবেও জানতেন তাদের কে কে মুনাফিক, তার পরও তিনি সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দেন। তাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করার পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেন।
একবার নবীজি (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে এবং বলতে থাকে, ধুলো উড়াবেন না। এরপর নবীজি (সা.) উপস্থিত ব্যক্তিদের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করলে সে বলতে লাগল, ‘জনাব আপনার কথা সত্যও যদি হয়, তবু আমার কাছে এই পদ্ধতিটি পছন্দ হয় না।
আমাদের মজলিসগুলোতে এসে আমাদেরকে দ্বিনের দাওয়াত দেবেন না। যারা আপনার কাছে যায় তাদেরকে দ্বিন শোনান।’ তার এই অসৌজন্যমূলক আচরণ ও ধৃষ্টতার কারণে সাহাবিরা তার ওপর হামলে পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু মহানবী (সা.) সবাইকে থামিয়ে দেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/৩১)
Leave a Reply