সংকটে স্থিরতা ও অবিচলতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য

  • আপডেট সময় শনিবার, জানুয়ারি ৮, ২০২২
  • 425 পাঠক

ড. সালমান আল আওদাহ   

————————–

পার্থিব জীবনের বাস্তবতা বড়ই তিক্ত ও কঠিন। নানা ধরনের বেদনা ও যাতনায় পূর্ণ মানবজীবন। চারপাশের অন্তহীন দুঃখ-শোকের ভেতরে, নিদারুণ সংকটের দরুন অনেকে লাগামহীন হয়ে পড়ে। নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে না। রাগে ফেটে পড়ে।

প্রতিক্রিয়াশীল ও আতিশয্যপরায়ণ হয়ে পড়ে। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করে। মানুষকে আঘাত করে, কষ্ট দেয়। মানুষ তখন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কারণ জানে, সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই; বরং তা যন্ত্রণাকাতর হৃদয় থেকে উৎসারিত বাক্যমালা। কষ্টের বর্ণমালা। অসহ্য যন্ত্রণায় মোচড়ে ওঠা অন্তরের গীত। সমস্যাজর্জরিত জীবনের বিলাপ।

কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখে মানুষ কষ্ট পায়। লাগামহীন আচরণে বিদ্ধ হয়। তখন সংকট দ্বিগুণ হয়। কিন্তু মানুষ যদি সুস্থ বিবেক ও স্থির মন নিয়ে সংকটের মোকাবেলা করে, তবেই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু সংকটের ভয়াবহতা দেখে যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তখন সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।

খাব্বাব ইবনে আরাত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একবার আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করতে গেলাম। তিনি তখন কাবার ছায়ায় একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। আমরা বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্যের আবেদন করবেন না? আমাদের জন্য দোয়া করবেন না?

তিনি বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী সময়ে দাওয়াতের কাজ করা লোকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। জমিনে গর্ত করে তাঁদের সেখানে রাখা হতো। লম্বা করাত দিয়ে তাঁদের মাথা দ্বিখণ্ডিত করা হতো। লোহার চিরুনি দিয়ে তাঁদের হাড্ডি থেকে গোশত আলাদা করা হতো। এমন বিভীষিকাময় শাস্তি পর্যন্ত তাঁদের দ্বিন থেকে ফেরাতে পারত না।

আল্লাহর কসম! এ দ্বিন একদিন পূর্ণতা পাবেই। এমনকি একজন মুসাফির সানা শহর থেকে হাজরামাউত শহর পর্যন্ত নির্ভয়ে সফর করবে। কাউকে ভয় পাবে না। শুধু তার ছাগলপালের ওপর বাঘের ভয় করবে। অথচ তোমরা অস্থির হচ্ছ! তড়িঘড়ি করছ!’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৩৬১২)

আমি প্রায় অবাক বিস্ময়ে এই হাদিসের কথা ভাবি। এই আপাতবিরোধী ব্যাপার দুটি দেখে আমার বিস্ময় আরো দ্বিগুণ হয়। ঘোর লেগে যায়। একদিকে ব্যথাতুর আহত মন এবং একবুক কষ্ট নিয়ে সাহাবারা রাসুল (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করছে, ‘আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্যের আবেদন করবেন না? আমাদের জন্য দোয়া করবেন না?’ অথচ অন্যদিকে নবীজি (সা.) চাদর মুড়ি দিয়ে কাবার চত্বরে বসে আছেন!

নিজ ধর্ম ও মতাদর্শের প্রতি এমন আত্মমর্যাদাশীল, নিষ্ঠাবান, ব্যাকুল ও আসন্ন সাহায্যের ব্যাপারে উদ্গ্রীব রাসুল (সা.)-এর চেয়ে কেউ কি আছেন? মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আপনি হয়তো তাদের পেছনে নিজেকে শেষ করে দেবেন।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৬)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি তাদের নিয়ে চিন্তিত হবেন না। তাদের ষড়যন্ত্র নিয়ে কুণ্ঠিত হবেন না।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৭)

চারপাশে শত্রুদের লাগামহীন ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের তীব্রতা উপেক্ষা করে তিনি শান্ত ও প্রশান্ত থাকতেন। তাঁর মধ্যে বিন্দু পরিমাণও অস্থিরতা দেখা যেত না। নীরব ও চুপচাপ থেকে কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন।

সংকটে স্থিরতা

নিদারুণ সংকটে রাসুল (সা.)-এর এমন প্রশান্ত ও স্থির থাকাটা আমাদের একটা বার্তা দেয়। সংকট মোকাবেলায় ক্রোধ, প্রতিক্রিয়া, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ কোনো সমাধান করতে পারে না। সংকট নানা ধরনের হতে পারে।

যেমন : ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত কিংবা মানসিক অথবা সামগ্রিক সংকট কোনো কিছুর মোকাবেলায় অস্থিরতা কোনো কাজে আসে না। মানুষের সঙ্গে যেকোনো লেনদেন ঠাণ্ডা মেজাজে ও প্রশান্ত মন নিয়ে করতে হবে।

তবে ঠাণ্ডা মেজাজ নিয়ে কাজ করা মানে খারাপ কিছু মেনে নেওয়া নয়। কিছুতেই কোনো কিছুর প্রতি সমর্পিত হওয়া নয়। সর্বদা নিজের ওজন ও ভারসাম্য ধরে রাখতে হবে। কিছুতেই রুক্ষ মেজাজ নিয়ে সংকট মোকাবেলা করা যাবে না। রেগে গেলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, অসুস্থ ও অস্থির হয়ে পড়ে, সঠিক উপায়ে কাজ করতে পারে না এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই আলেমরা বলেন, ‘সূর্য ডুবে গেলে আলো যেমন ম্লান হয়ে যায়, তেমনি রেগে গেলে বুদ্ধির প্রভা হারিয়ে যায়।’

সূর্য যখন উদিত হয়, সমগ্র পৃথিবী আলোয়-দীপ্তিতে ভরে যায়। গোটা চরাচর রোদে ঝলমলিয়ে ওঠে। বুদ্ধি ও বিবেকও অনেকটা তেমনি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ ও সুন্দর করে। চোখের সামনে সূক্ষ্ম ও খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো তুলে ধরে। সূর্য যখন ডুবে যায়, তার আলো ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে যায়।

তেমনি মানুষের মধ্যে যখন রাগ ও ক্রোধ জন্মে, তখন নিমিষেই তার বুদ্ধির প্রখরতা, দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও ভারসাম্য চলে যায়। তখন সে নির্বোধের মতো আচরণ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এমন কাজ করে বসে যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় কস্মিনকালেও করতে পারবে না। রাগ দূর হলে নিজের কৃতকর্মের কথা চিন্তা করে মাথার চুল ছিঁড়ে।

তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রাগের মাথায় কেউ যেন দুজনের মধ্যে বিচার করতে না যায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭১৫৮)

কারণ দুই পক্ষের মাঝে বিচার করতে সুস্থ মস্তিষ্ক ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। উভয় পক্ষের কথা শোনা উচিত। মানুষ যদি রেগে যায়, তাহলে সে কিছুতেই সূক্ষ্মভাবে, পরিশুদ্ধ উপায়ে কাজ করতে পারে না। যেকোনো সংকট মোকাবেলায় সুস্থ মন-মস্তিষ্ক ও স্থিরতা খুবই প্রয়োজন। তার মানে এই নয়, অন্যায় ও ভুলের সময় চুপচাপ ও নীরব থাকতে হবে; বরং সংকট মোকাবেলায় ধীরগতিতে ভেবে-চিন্তে কাজ করতে হবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!