কম কথা বলা মানুষের উত্তম গুণাবলির অন্যতম। কম কথা বলা বা চুপ থাকার কারণে মানুষ অনেক বিপদ থেকে বেঁচে যায়। চুপ থাকার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি পাওয়া যায়। ভালো কথা বলা যেমন ইবাদত, তেমনি চুপ থাকাটাও ইবাদত। বেশি কথা বললে বিপদও বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে কথা বললে পদস্খলন অনেকাংশে কমে যায়। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা নিম্নরূপ—
১. সব কথাই রেকর্ড হয় : মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, পরিদর্শক ফেরেশতারা তা রেকর্ড করেন। কথায় কোনো গুনাহ অথবা সওয়াব থাকুক বা না থাকুক, সব কথাই রেকর্ড হয়। এরপর সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে পরিদর্শক ফেরেশতারা লিখিত বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করেন এবং যেসব কথা সওয়াব অথবা শাস্তিযোগ্য, সেগুলো রেখে বাকিগুলো মিটিয়ে দেন। (মাআরিফুল কোরআন)
এ মর্মে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই আছে।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ১৮)
২. ভালো কথা বলা বা চুপ থাকা : কথার মাধ্যমে ঈমানের প্রকাশ ঘটে। ঈমানের দাবি হলো, ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা। ঈমানদার মানুষ অনর্থক, অযথা, মিথ্যা, পরনিন্দা ও প্রতারণামূলক কথা বলতে পারে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮; মুসলিম, হাদিস : ১৮২)
৩. চুপ থাকায় মুক্তি : যত কম কথা বলা যায়, ততই কল্যাণকর। রাসুলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘক্ষণ নীরবতা অবলম্বন করতেন। উমর (রা.) বলেন, চুপ থাকার কারণে আমি কখনো লজ্জায় পড়িনি। তবে কথা বলার কারণে আমি অনেকবার লজ্জিত হয়েছি।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে চুপ থাকে, সে পরিত্রাণ পায়। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০১)
৪. ভেবেচিন্তে কথা বললে পদস্খলন কম হয় : কথা একবার মুখ থেকে বের হয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। কাজেই কথার পরিণতি ও ফলাফল নিয়ে ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত। এতে পদস্খলন কম হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, মানুষ চিন্তা-ভাবনা না করে এমন কথাবার্তা বলে, যার দ্বারা তার পদস্খলন ঘটে পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যবর্তী দূরত্ব থেকে বেশি দূরত্ব দোজখে গিয়ে পতিত হয়। (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৭; মুসলিম, হাদিস : ৭৬৭২)
৫. জিহবা নিয়ন্ত্রণে মুক্তি : জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের জন্যও জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে নিজেকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। উকবাহ ইবন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! কিসে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব? তিনি বলেন, তুমি নিজ জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। তোমার ঘর তোমার জন্য প্রশস্ত হোক। (অবসর সময়ে নিজ গৃহে অবস্থান করো) আর নিজ পাপের জন্য ক্রন্দন করো। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০৬)
৬. জান্নাতের নিশ্চয়তা : জান্নাতপ্রাপ্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহের ফল। নিজের আমল দ্বারা জান্নাত নিশ্চিত করা যায় না। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) জবানের হিফাজতকারীর জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (অঙ্গ জিহ্বা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (অঙ্গ লজ্জাস্থান) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব। (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৪)
৭. সর্বোত্তম মুসলিম : যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে, সে-ই সর্বোত্তম মুসলিম। অনেক সময় হাতের আঘাতের চেয়েও কথার আঘাত বেশি কষ্টদায়ক হয়। এ জন্য হাদিসে মুখের অনিষ্টের কথা প্রথমে বলা হয়েছে।
আবু মুসা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বোত্তম মুসলিম কে? তিনি বলেন, যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্ট থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। (বুখারি, হাদিস : ১১; মুসলিম, হাদিস : ১৭২)
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথা পরিহার করা। অতএব ভালো কথা বলতে হবে অথবা চুপ থাকতে হবে। কাজের মূল্য বেশি, কথার নয়। সাহাবায়ে কিরাম কথা কম বলতেন, কাজ বেশি করতেন। বেশি কথা বললে বিপদ বেশি হয়। কাজেই ভেবেচিন্তেই কথা বলা উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply