————————
ইসলামে সুদ হারাম। ইন্টারেস্ট, মুনাফা, লাভ, ফিন্যানশিয়াল চার্জ অথবা সুদ; যে নামেই তাকে ডাকা হোক। চাই তা মহাজনি বা বাণিজ্যিক সুদ হোক। চাই তা সরল সুদ বা চক্রবৃদ্ধি কিংবা ব্যাংকিং সুদ হোক। কম হোক বা বেশি হোক। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
পবিত্র কোরআনে বহু ধরনের গুনাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সে সবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহের ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি।
সুদ সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের একটি: দুনিয়াতে যে সাতটি ধ্বংসাত্মক মহাপাপ আছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো সুদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী? তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া, মুমিন নারীদের অপবাদ দেয়া।’ (বুখারি: ২৭৬৬)
সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত: সুদের সঙ্গে জড়িত সবাইকে নবীজি (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন।’ (তিরমিজি: ১২০৬)
সুদের অর্থে কোনো বরকত নেই: সুদের মাধ্যমে যত অর্থই উপার্জন করুক, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাতে কোনো বরকত নেই। এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা বাকারা ২৭৬)
সুদখোর আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত: সুদখোর স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না কর (সুদের বকেয়া না ছাড়, সুদের কারবার অব্যাহত রাখ) তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও…।’ (সুরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯)
সুদখোর মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারকারীর সমতুল্য: ব্যভিচার সবার কাছে নিন্দনীয়। বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যভিচার আরো বেশি জঘন্য। আর স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে জড়িত। বর্ণিত আছে, ‘সুদ সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো— আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ১৫৩৪৫)
এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করার কারণ হলো—কোরআন নাজিল হওয়ার সময় আরবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খাওয়ার প্রথা ছিল। তাই তা দূর করার জন্য স্বতন্ত্রভাবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। তার মানে এ নয় যে চক্রবৃদ্ধিহারে না হলে সুদ খাওয়া হালাল হয়ে যাবে। কারণ অন্যান্য আয়াতে তো যেকোনো রকমের সুদ খাওয়াকে হারাম করা হয়েছে।
ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত: যেকোনো ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হালাল পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করা। এরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলরা, তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর এবং সৎকর্ম কর…।’ (সুরা মুমিনুন: ৫১)
হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোনো ধরনের ইবাদত আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌঁছায় না।’ (বুখারি: ৭৪৩০)
সুদখোরের বরজখি জীবনের শাস্তি: সুদখোরকে মৃত্যুর পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত বরজখি জীবনের আজাব দেয়া হবে। তার আজাব হবে— তাকে এমন নদীতে সাঁতার কাটতে হবে, যার পানি হবে রক্তের মতো লাল এবং তাতে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হতে থাকবে। (বুখারি : ১৩৮৬)
সুদখোরের পেট সাপে পরিপূর্ণ: রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিল অসংখ্য সাপে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল, এরা কারা? তিনি জবাবে বলেন, এরা সুদখোরের দল।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৪০)
সুদখোর কেয়ামতের দিন যে অবস্থায় উঠবে: কেয়ামতের দিন সুদখোর পাগলের মতো উঠবে। এরশাদ হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা (কেয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে। এটা এ জন্য যে তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই…।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
Leave a Reply