মিথ্যা মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতিবিরোধী। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিলে তার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তির দেহাবয়বে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আধুনিক সময়ে মিথ্যা নির্ণয়ের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে।
যেমন ব্যক্তির চেহারায় মিথ্যার ছাপ থাকা, হাতের শিরা অস্বাভাবিক নড়াচড়া, হৃত্স্পন্দন বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া, কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসা ইত্যাদি ব্যক্তির কথার সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে সহায়তা করে।
পবিত্র কোরআনেও মিথ্যাবাদীর কিছু নিদর্শন বলা হয়েছে, যা আধুনিক সময়ের বৈজ্ঞানিকভিত্তিক পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ইচ্ছা করলে আপনাকে তাদের পরিচয় দিতাম। ফলে আপনি তাদের লক্ষণ দেখে তাদের চিনতে পারতেন। তবে আপনি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবেন। আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত। ’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ৩০)
তাফসিরবিদরা উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সিমাহুম’ (তাদের লক্ষণ) দ্বারা চেহারায় প্রস্ফুটিত ভাব উদ্দেশ্য। আর ‘লাহনিল কাউল’ (কথাভঙ্গি) দ্বারা কণ্ঠস্বরের উঠা-নামা ও কম্পন উদ্দেশ্য। আধুনিক বিজ্ঞানও মিথ্যার এই প্রভাবগুলো স্বীকার করে।
মিথ্যা শনাক্তকরণের আধুনিক পদ্ধতি
মিথ্যা শনাক্তকরণে বর্তমান সময়ে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর তিনটি পদ্ধতি এখানে তুলে ধরা হলো :
১. দৃষ্টি পরীক্ষা : মানুষ শুধু মুখ দিয়ে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে না; বরং তার অভিব্যক্তি প্রকাশে ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (দেহভঙ্গি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
গবেষকরা বলেন, একজন মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন সে তার দেহভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিশেষত তার ‘আইকন্টাক্ট’ বা দৃষ্টিতে তার ছাপ প্রস্ফুটিত হয়। সেখানে ভয়, সংকোচ ও উদাসীনতা ধরা পড়ে।
২. কণ্ঠ পরীক্ষা : কথার সত্য-মিথ্যা প্রমাণে আধুনিক একটি পদ্ধতি হলো মানুষের কণ্ঠস্বর পরীক্ষা। গবেষকরা মানুষ যখন সত্য বলে সে সময়ের এবং যখন মিথ্যা বলে সে সময়ের কণ্ঠস্বর পৃথকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন। তারা উভয় সময়ের কণ্ঠস্বর ও ধ্বনি তরঙ্গের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন। মিথ্যা বলার সময় মানুষের কণ্ঠস্বর ও ধ্বনি তরঙ্গ স্বাভাবিক থাকে না।
৩. মস্তিষ্ক পরীক্ষা : গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন তার মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা ‘এফএমআরআই’ তথা চম্বুকীয় পদ্ধতিতে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছেন।
কোরআনের ভাষ্যে মিথ্যার নিদর্শন :
পবিত্র কোরআনে মিথ্যাবাদীদের যেসব নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে তার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর মিল আছে। নিম্নে কোরআনের ভাষ্য তুলে ধরা হলো—
১. চেহারায় মিথ্যার ছাপ : কোরআনের বর্ণনা অনুসারে মানুষের চেহারায় মিথ্যার ছাপ স্পষ্ট হয়। যা আধুনিক বিজ্ঞানের বক্তব্যও অনুরূপ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে আপনাকে তাদের পরিচয় দিতাম। ফলে আপনি তাদের (চেহারার) লক্ষণ দেখে তাদের চিনতে পারতেন। ’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ৩০)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। উদ্ধতদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৬০)
২. কণ্ঠে মিথ্যা প্রকাশ : আধুনিক বিজ্ঞান বলে মানুষের কণ্ঠস্বরে তারতম্য তৈরি হয় যখন সে মিথ্যা বলে। অন্যদিকে কোরআনের বক্তব্য হলো—‘আপনি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবেন। আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত। ’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ৩০)
৩. কপালে মিথ্যার ছায়া : মিথ্যা বললে মানুষের মস্তিষ্কের সম্মুখ ভাগ হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তার কপালের রগ ফুলে যায়। পবিত্র কোরআনে সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ। ’ (সুরা আলাক, আয়াত : ১৬)
৪. অন্তরে মিথ্যার অস্থিরতা : মিথ্যার প্রভাবে মানুষের হৃত্স্পন্দন বেড়ে যায়, এটা আধুনিক বিজ্ঞানের দাবি। কোরআনে মানুষের মিথ্যাবাদী অন্তরের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ‘চোখের অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। ’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ১৯)
৫. সত্যের প্রভাবও থাকে চেহারায় : কোরআনের বক্তব্য অনুসারে শুধু মিথ্যা নয়, বরং সত্য কথারও প্রভাব থাকে মানুষের মুখমণ্ডলে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পুণ্যবানরা থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে। তারা সুসজ্জিত আসনে বসে অবলোকন করবে এবং তুমি তাদের মুখমণ্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের দীপ্তি দেখতে পাবে। ’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ২২-২৪)
মানুষ জানতে পারুক আর না পারুক সর্বাবস্থায় ইসলাম মানুষকে মিথ্যা পরিহারের নির্দেশ দেয়। কেননা মানুষের কোনো কাজ মহান আল্লাহর কাছে গোপন নয়।
আল্লাহ বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব তিনি জানেন এবং তিনি জানেন তোমরা যা গোপন করো এবং তোমরা যা প্রকাশ করো। তিনি অন্তর্যামী। ’ (সুরা তাগাবুন, আয়াত : ৪)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মিথ্যা কথা পরিহার কোরো। ’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩০)
আল্লাহ সবাইকে মিথ্যা পরিহারের তাওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply