সমাজজীবনে মন্দ ধারণার কুপ্রভাব

  • আপডেট সময় বুধবার, মার্চ ৩০, ২০২২
  • 273 পাঠক

মাওলানা শামসুল হক নদভি

—————————-

আমাদের বড় একটি দুর্বলতা হলো আমরা নিজের হিসাব নেওয়ার আগে অন্যের হিসাব নেই। নিজের ভুল ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার পরিবর্তে নিজের প্রতি শতগুণ সুধারণা পোষণ করি।
অন্যের সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও চিন্তা-ভাবনা ও সমালোচনার সব সীমা অতিক্রম করে যাই। নিজের প্রতি সুধারণা ও অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণের এই প্রবণতা সামাজিক, গঠনমূলক ও কল্যাণের কাজে আমাদের একতাবদ্ধ হওয়ার পথ রোধ করে।

কেননা তখন নিজের সামান্য ভালো কাজও বেশি মনে হয় এবং অন্যের বহু অবদানও সামান্য মনে হয়। ফলে আমরা পরস্পরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না। উল্টো কখনো কখনো অবমূল্যায়ন করা হয়। যা মানুষকে ভালো কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করে। এই মন্দ প্রবণতা সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এ ধারণা ভালো কাজে পরস্পরকে সহযাত্রী হতে দেয় না, অবমূল্যায়নের কারণে কল্যাণের সারথিদের সামনে অগ্রসর হতে দেয় না। এ জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কিছু ধারণা পাপতুল্য। ’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১২)

বেশির ভাগ সময় মানুষের প্রতি মন্দ ধারণাগুলোর কোনো ভিত্তি বা প্রমাণ থাকে না। তার পরও আমরা তা অন্তরে পুষে রাখি। আমাদের উচিত কোনো শোনা কথার ভিত্তিতে বা অনুমানের ভিত্তিতে কারো প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ না করা; বরং কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার আগে দেখা উচিত ওই ব্যক্তির ভেতর কী কী ভালো গুণ আছে, আল্লাহ তার মাধ্যমে কী কী সেবা নিচ্ছেন।

এভাবে ইতিবাচক চিন্তা করলে সমাজ এগিয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘উত্তম ধারণা উত্তম ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৬০৪)

আর মন্দ ধারণার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বেশি বেশি ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কেননা মন্দ ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭২৪)

পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যেন অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে না বসো এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়। ’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ৬)

উল্লিখিত আয়াতে যদিও মুসলিমদের মুনাফিকদের সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। তবু যেকোনো যুগের মুমিনরা যেকোনো অসত্য প্রচারকারীদের থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। কেননা কোরআনের আয়াত কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষায়িত নয়। বর্তমান সমাজের বহু মানুষ অসত্য প্রচারে লিপ্ত এবং তারা এটা ভালো কাজই মনে করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা ধারণা করছে তারা উত্তম কাজ করছে। ’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ১০৪)

ইসলাম সেই মহান ধর্ম, যা শত্রুর সঙ্গে সুবিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। শত্রুতার কারণে শত্রুর সঙ্গে অবিচার করার অনুমতি ইসলামে নেই। অথচ আমরা অপর মুসলমানের ব্যাপারেও ন্যায় ও অন্যায়ের ধার ধারি না। কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি না থাকার পরও অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করি এবং সে অনুসারে তাদের সঙ্গে আচরণ করি।

ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা আল্লাহভীতির নিকটতর এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪)

নিজের প্রতি সুধারণা ও অন্যের প্রতি মন্দ ধারণার রোগ থেকে বাঁচতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যেন প্রবৃত্তি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে। কেননা প্রবৃত্তির ক্ষতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। যা বেশির ভাগ মানুষ অনুভব করতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আমার নিজের প্রবৃত্তির ক্ষতি থেকে আশ্রয় কামনা করছি। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৬৩)

প্রবৃত্তির কাজই হলো নিজের মন্দ কাজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে তা ভালোতে রূপান্তরিত করা। আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘চিন্তা চুপে চুপে অন্তরে ছবি এঁকে দেয়। ’ অন্তরের আঁকা ছবি ও নিজের দুর্বলতার কারণে আমরা বেশির ভাগ সময় নিজেদের হাতে গড়া প্রাসাদ ধসিয়ে দিই, নিজের অজ্ঞাতে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস করি।

আরব উপকথার সেই বৃদ্ধার মতো যে বহু কষ্টে সুতা কাটে এবং পরবর্তী সময়ে নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে তা ছিঁড়ে ফেলে। কোরআনে এমন নির্বুদ্ধিতার ব্যাপারে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সেই নারীর মতো হয়ো না যে তার সুতা মজবুত করে পাঁকানোর পর তার পাঁক খুলে নষ্ট করে দেয়। ’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯২)

এই মুহূর্তে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবীতে বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও তৎপরতা চলছে। বিপরীতে আমরা আত্মরক্ষার পরিবর্তে নিজেদের দুর্গ নিজ হাতেই বিনাশ করছি।

আমাদের অবস্থা সেই দুর্ভাগা জাতির মতো, যাদের শত্রুরা অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং শহররক্ষীরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়েছে যে কে কোন অংশের নেতৃত্বে দেবে। আল্লাহ মুসলিম জাতিকে এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

তামিরে হায়াত থেকে।

মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!