বান্দা ইবাদতে মগ্ন হয় আল্লাহর নির্দেশ মান্য করার জন্য। এমনকি সে যদি বিধানের কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়গুলো না জানে, তবু সে তা পালন করা থেকে পিছপা হয় না। তবে এটা নিশ্চিত যে আল্লাহর বিধান কল্যাণশূন্য নয়। আধুনিক বিজ্ঞান ইসলামের বিধানগুলোর কল্যাণের নানাদিক প্রমাণ করেছে।
যেমন রোজা। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বলছে রোজা মানবদেহের জন্য প্রভূত কল্যাণের ধারক। নিম্নে রোজা রাখার সাতটি অসাধারণ উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো।১. তারুণ্য ধরে রাখা : রোজা মানবদেহে তারুণ্য ও রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। জাপানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তা হলো—মানুষের সারা শরীর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলো কিছুটা কারখানার মতো। এখানে সারা দিন কাজ চলছে, কিছু আবর্জনা তৈরি হচ্ছে, কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙে যাচ্ছে, কিছু মেশিন নষ্ট হচ্ছে। সেগুলো মেরামতের প্রয়োজন হয়। এই কাজটা কোষ নিজেই করে অটোফিজি নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
অকার্যকর ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো রিসাইকেল করে তা আবার ব্যবহারের যোগ্য করে তোলে, কোষকে সতেজ হতে সাহায্য করে এবং শরীরে তারুণ্য ধরে রাখতে সহযোগিতা করে। এই প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না হলে ব্রেনের বিভিন্ন রোগ যেমন অলঝেইমার্স—যে রোগে বয়স্করা ভুলে যেতে থাকে, আবোলতাবোল বলে; পারকিনসন্সের মতো রোগগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে। মানুষ যদি সারাক্ষণ খাওয়ার মধ্যে থাকে, তখন অটোফেজি প্রক্রিয়া দমে থাকে। অন্যদিকে রোজা অবস্থায় অটোফেজি প্রক্রিয়া বেড়ে যায়। (প্রবন্ধ : Autophagy in healthy aging and disease)
২. শরীরের চর্বি কমান : রোজা মেটাবলিক সুইচ করে শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। মানুষের শরীর পরিচালনার জন্য জ্বালানির প্রয়োজন হয়। শরীর সেই জ্বালানি সংগ্রহ করে খাবার থেকে বা আগ থেকে জমিয়ে রাখা গ্লাইকোজেন থেকে। তা হলো এক প্রকার চিনি। মানুষ যখন রোজা রাখে তখন ১০-১২ ঘণ্টায় এই জ্বালানি শেষ হয়ে আসে। তখন পরিচালনার জন্য শরীরকে আগ থেকে জমানো চর্বিতে হাত দিতে হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম মেটাবলিক সুইচ। অর্থাৎ চিনি থেকে সুইচ করে চর্বিতে আসা। সম্প্রতি করা গবেষণায় দেখা গেছে এই প্রক্রিয়ার ফলে মানবদেহে বেশ কিছু উপকারিতার সম্ভাবনা আছে। যেমন হার্ট ভালো রাখা, পেটের চর্বি কমা, ব্লাডপ্রেসার কমা, রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি। (প্রবন্ধ :
Flipping the Metabolic Switch: Understanding and Applying Health Benefits of Fasting)
৩. পেটের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া : মানবদেহের নাড়ি-ভুঁড়িতে অনেক জীবাণুর বসবাস, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করাসহ আরো অনেকভাবে স্বাস্থ্যের উপকার করে। না খেয়ে থাকলে শরীরে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে। অর্থাৎ রোজা রাখলে এই ক্ষেত্রে উপকারিতা আছে। (প্রবন্ধ : Fasting challenges human gut microbiome resilience and reduces Fusobacterium)
৪. ওজন কমানো : বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের করা ৩৫টি গবেষণা একত্র করে দেখা গেছে রমজানের রোজার পর গড়ে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে। এটা গড় হিসাব। অর্থাৎ কারো ওজন এর থেকে বেশি কমেছে, আবার কারো ওজন বেড়েছে। (প্রবন্ধ : Effects of ramadan and non-ramadan intermittent fasting on body composition: A systematic review and meta-analysis.)
৫. রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ : রক্তে সুগারের মাত্রা থেকে বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কেমন। নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে পরিমাণে বেশি সুগার থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এই ক্ষেত্রে রোজা রাখলে উপকারিতা পাওয়া যায়। তুরস্কের গবেষকরা ইরান, মিসর, কুয়েতসহ আরো কয়েকটি দেশের করা ১৬টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন যে রোজা রাখার পর নারী-পুরুষ উভয়ের রক্তে সুগারের মাত্রা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
আরেকটি আলাদা গবেষণায় ইন্দোনেশিয়ার গবেষকরা ২৮টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন, রমজানের রোজা রাখার ফলে ডায়াবেটিক রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খানিকটা উন্নতি হয়েছে। যারা ডায়াবেটিক রোগী তারা রোজা রাখা অবস্থায় আপনার ওষুধ কখন ও কিভাবে গ্রহণ করবেন, সেটা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন। (প্রবন্ধ : Time restricted eating for the prevention of type 2 diabetes)
৬. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ : রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রোজা উপকারী। মানুষের রক্তে এক ধরনের চর্বি থাকে, যাকে কোলেস্টেরল বলে। কোলেস্টেরল অনেক বেশি পরিমাণে থাকলে রক্তনালিতে চর্বি জমে নালি সরু হয়ে যেতে পারে। এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের গবেষকরা ৯১টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন, রমজানের রোজায় রক্তে কোলেস্টেরল আগের তুলনায় ভালো নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেরও তিনটি গবেষণা আছে। (প্রবন্ধ : Effect of Ramadan Fasting on Total cholesterol (TC) Low density lipoprotein cholesterol (LDL-C) and High density lipoprotein cholesterol (HDL-C) in Healthy Adult Male)
৭. ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ : ২০১৯ সালে লন্ডনের পাঁচটি মসজিদে একটি গবেষণা হয়। গবেষণার নাম ‘লন্ডন রামাদানস স্টাডি’। রমজানের আগে-পরে ব্লাড প্রেসার মেপে দেখা যায় কোনো পরিবর্তন আছে কি না? সেখানে দেখা গেল সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার তথা ব্লাড প্রেসারের ওপরের সংখ্যাটা কমেছে সাত মিলিমিটার মার্কারি আর দ্বিতীয় সংখ্যাটি কমেছে তিন মিলিমিটার মার্কারি।
ভারত, পাকিস্তান, কাতারসহ অন্যান্য দেশের আরো ৩২টি গবেষণা একত্র করে দেখা গেছে রমজানের রোজায় ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আসে ওজন না কমলেও। ইফতার ও সাহরিতে বেশি বেশি ফলমূল খেলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা আরো সহজ হবে। (প্রবন্ধ : Effect of Religious Fasting in Ramadan on Blood Pressure: Results From LORANS (London Ramadan Study) and a Meta Analysis)
তথ্যঋণ : ডা. তাসনিম জারার ‘রোজার অসাধারণ সাতটি উপকার’ শীর্ষক আলোচনা।
Leave a Reply