———————————–
মানবজীবনে বিভিন্ন সংকট দেখা দিতে পারে। এই সংকট হতে পারে খাদ্যের, হতে পারে অর্থের অথবা অন্য কিছুর। সংকটের পরিধি ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র পর্যন্ত চলে যেতে পারে। কখনো নিজেদের অপরাধ আবার কখনো মহান আল্লাহর পরীক্ষার কারণে সংকট আসতে পারে।
সংকট নিরসনে ইসলামের টেকসই সমাধান রয়েছে।ঈমান ও তাকওয়া : জীবনে সত্যিকার সুখশান্তি ও পরিতৃপ্তি দানের মালিক আল্লাহ। তিনিই বান্দার সব সংকট দূর করেন। তাঁর প্রতি ঈমান এবং তাকওয়া অর্থাৎ তাঁকে ভয় করে চলার নীতি অবলম্বন করলে সেই জনপদকে তিনি সুখশান্তিতে ভরে দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যদি সেই সময় জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান ও জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, অতঃপর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত: ৯৬)
আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য বরকতের দুয়ার খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বরকতের অর্থ যথাসময়ে বৃষ্টিপাত, ফল-ফসল, পশু-পাখির উৎপাদন, জীবন-জীবিকার সচ্ছলতা এবং শান্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া।
তাওয়াক্কুল : তাওয়াক্কুল অর্থ ভরসা করা, নির্ভর করা। মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈমানদার মানুষ ভালো ও কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য নিজে সাধ্যমতো চেষ্টা করে এবং ফলাফলের জন্য মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে। তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি কখনো হতাশ হয় না। বিপদ-আপদ ও যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায় না। যেকোনো দুর্বিপাক, দুর্যোগ, সংকট, বিপদ-আপদে আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট। ’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)
উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ তাওয়াক্কুল (ভরসা) করো তাহলে তিনি তোমাদের এমনভাবে রিজিক দেবেন যেমন তিনি রিজিক দেন পাখিদের। তারা সকালে খালি পেটে বের হয় আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৪)
ইস্তিগফার : ইস্তিগফার হলো মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি একটি অন্যতম ইবাদত। এর মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়, বৃষ্টি বর্ষিত হয়, সন্তান ও সম্পদ দ্বারা উপকার পাওয়া যায়। সর্বপরি পরকালীন জীবনে চিরস্থায়ী জান্নাতের অধিকারী হওয়া যায়। এক কথায় সব সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘বলেছি, তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য বৃষ্টিপাত করবেন, তিনি তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদীনালা। ’ (সুরা : নুহ, আয়াত : ১০-১২)
অপচয় ও অপব্যয় বন্ধ করা : বৈধ কাজে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করা হলো ইসরাফ বা অপচয়। আর অবৈধ কাজে ব্যয় করা হলো তাবজির বা অপব্যয়। দুটোই ইসলামে দোষণীয় ও নিষিদ্ধ। প্রথমটির ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘এবং আহার করবে ও পান করবে, কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
দ্বিতীয়টির ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। ’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ২৬-২৭)
সব ধরনের অপচয় ও অপব্যয়মূলক ব্যয় বন্ধ করা গেলে কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি হওয়ারই কথা নয়।
আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা : আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা দীর্ঘমেয়াদি প্রশান্তির জন্য খুবই জরুরি। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা না থাকলে দারিদ্র্য এগিয়ে আসে। অনেক সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে মূল সম্পদও হারিয়ে যায়। পক্ষান্তরে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকলে সাধারণত অভাব আসে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ যে ব্যক্তি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে সে কখনো অভাবগ্রস্ত হয় না। ’ (মসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৪২৬৯)
দুর্নীতি দমন করা : ইসলামে আর্থিক লেনদেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইবাদত বন্দেগি আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য যেমন প্রয়োজন নিখুঁত ঈমান, তেমনি ইবাদতকে পরকালীন জীবনে প্রতিদান লাভের উপযোগী ও রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন আর্থিক স্বচ্ছতা। বিভিন্নভাবে আর্থিক স্বচ্ছতা বিনষ্ট হয়। যেমন—অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা, ঋণ পরিশোধ না করা, অন্যের প্রাপ্ত অধিকার প্রদান না করা, চুরি-সন্ত্রাসী করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথার্থ ব্যবহার না করা ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার মানে দেশের সব মানুষের সম্পদের অপব্যবহার। কারণ এ সম্পদের মালিক দেশের সব জনগণ। দুর্নীতিকে কঠোরভাবে দমন করা গেলে কোনো ধরনের সংকট থাকারই কথা নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ : সময় সব সময় এক রকম যায় না। কখনো মানুুষ অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। খাদ্যশস্য বা ধন-সম্পদের কিছুটা রিজার্ভ বা সংরক্ষণ দরকার। ইউসুফ (আ.) মিসরের খাদ্যভাণ্ডারের দায়িত্ব নিয়ে এমনটাই করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘ইউসুফ বলল, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষাবাদ করবে, অতঃপর তোমরা যে শস্য কাটবে তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে, তা ছাড়া সব শীষসমেত সংরক্ষণ করবে। এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে, এই সাত বছর, যা পূর্বে সঞ্চয় করে রাখবে লোকে তা খাবে; শুধু সামান্য কিছু যা তোমরা (বীজ হিসেবে) সংরক্ষণ করবে, তা ছাড়া। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৮)
জাকাতব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা : জাকাত ইসলামের অন্যতম মৌলিক আর্থিক একটি ইবাদত। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, বুদ্ধিসম্পন্ন ও সম্পদশালী মুসলিম নর-নারী বছরান্তে তার সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫ শতাংশ) গরিব-অসহায়দের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রদান করাই জাকাত। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো ও জাকাত আদায় করো, তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১০)
আসলে পৃথিবীর সব মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা দরকার আল্লাহ তা সৃষ্টি করেছেন। সুষম বণ্টনের অভাবে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। জাকাত এই বৈষম্য দূর করে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। জাকাতব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণ সহজ হবে। ফলে সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে।
পরিশেষে বলা যায়, উল্লিখিত বিষয়াবলির বাস্তবায়ন সব সংকট দূর করে সমৃদ্ধ জীবন গড়তে সহায়ক হবে—ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply