————————————-
বারো আউলিয়ার দেশ—বাংলাদেশ, বলতে বিশেষত চট্টগ্রামের পরিচয় বোঝায়। চট্টগ্রামের আরেক নাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুটি স্থানে বারো আউলিয়ার সমাধি আছে। একটি হলো সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে অবস্থিত বারো আউলিয়ার খানকা। এখানে বারো আউলিয়ার মাজার নেই। স্থানটি বারো আউলিয়ার সম্মিলনস্থল বা দরগা ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, ভিনদেশি কয়েকজন ওলি এখানে বসে পরামর্শ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে জায়গাটি বারো আউলিয়ার মাজার, দরগা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
চট্টগ্রাাম-হাটহাজারী সড়কের বালুছড়ায় ১৯৩৩ খ্রি. নির্মিত বারো আউলিয়া নামে একটি মসজিদ আছে।
বাংলাদেশে বারো আউলিয়া একটি সম্মানজনক অভিধা। বেশ কিছু এলাকায় বারো আউলিয়ার খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন—ড. গোলাম সাকলায়েনের ‘বাংলাদেশের সূফী-সাধক’ গ্রন্থে বর্ণিত চট্টগ্রামের ‘বারো আউলিয়া’র ১০ জন হলেন—
১. সুলতান বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)। ২. শেখ ফরিদ (রহ.)। ৩. বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহ.)। ৪. কতল পীর (পীর কতল) (রহ.)। ৫. শাহ মহসিন আউলিয়া (রহ.)। ৬. শাহ পীর (রহ.)। ৭. শাহ উমর (রহ.)। ৮. শাহ বাদল (রহ.)। ৯. শাহ চাঁদ আউলিয়া (রহ.)। ১০. শাহ জায়েদ (রহ.)।
মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার বিক্রমপুরের বড় কেওয়ার গ্রামের তেঁতুলতলায় এক প্রাচীন মাজারে প্রাপ্ত শিলালিপিতে বর্ণিত বারোজন আউলিয়া হলেন—
১. শাহ সুলতান হুসাইনি (রহ.)। ২. সুলতান সাব্বির হুসাইনি (রহ.)। ৩. কবির হাশেমি (রহ.)। ৪. আল হাসান (রহ.)। ৫. শায়খ হুসাইন (রহ.)। ৬. আবুল হাশেম হুসাইনি (রহ.)। ৭. আবু বকর সিদ্দিক (রহ.)। ৮. ইয়াসিন (রহ.)। ৯. ওবায়েদ ইবনে মুসলিম আসাদি (রহ.)। ১০. আবদুল হালিম (রহ.)। ১১. শাহাদাত হুসায়নি (রহ.)। ১২. আবদুল কাহহার বাগদাদি (রহ.)।
ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সাতৈর গ্রামে সমাধিস্থ বারো আউলিয়া হচ্ছেন—১. উড়িয়ান শাহ (রহ.)। ২. ময়েজউদ্দিন কানি শাহ (রহ.)। ৩. লাল শাহ (রহ.)। ৪. কলিম উল্লাহ শাহ (রহ.)। ৫. ময়েজউদ্দিন ইয়ামানি (রহ.)। ৬. শাহ বোখারি (রহ.)। ৭. বুট্টি শাহ বাগদাদি (রহ.)। ৮. জায়েদ শাহ বাগদাদি (রহ.)। ৯. জালাল শাহ বাগদাদি (রহ.)। ১০. মুছি শাহ হাক্কানি (রহ.)। ১১. শাহ আলি ছতরি (রহ.)। ১২. আবদুল্লাহিল কাফি (রহ.)।
হজরত শাহজালাল (রহ.) এর অন্যতম সঙ্গী, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের খোয়াই তীরবর্তী মুড়ারবন্দে সমাধিস্থ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহ.)-এর সঙ্গে একটি যুদ্ধে অংশ নেওয়া বারো আউলিয়া হলেন—১. শাহ গাজি (রহ.)। ২. শাহ মজলিস আমিন (রহ.)। ৩. শাহ ফতেহ গাজি (রহ.)। ৪. সৈয়্যদ শাহ সায়েফ মিন্নাত উদ্দিন (রহ.)। ৫. শাহ আরেফিন (রহ.)। ৬. শাহ তাজ উদ্দিন কুরাইশি (রহ.)। ৭. শাহ রোকন উদ্দিন আসোয়ারি (রহ.)। ৮. শাহ বদর (রহ.)। ৯. শাহ মাহমুদ (রহ.)। ১০. শাহ সুলতান (রহ.)। ১১. শাহ বদর উদ্দিন (রহ.)। ১২. সৈয়্যদ আহমদ গিছুদরাজ (রহ.)।
এ ছাড়া ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জের বারো বাজার নামক স্থানেও বারো আউলিয়ার মাজার আছে।
শাহ বদর (রহ.) ১১ জন দরবেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সমসাময়িক শাহ বদর (রহ.) ও তাঁর সঙ্গীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সমাহিত। বারোজনের মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামবাসী তাদের অভিভাবকের মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধা করেন। চট্টগ্রামবাসী তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকেন, যেমন—বদর আলম, বদর আউলিয়া, বদর পীর বা পীর বদর ও বদর শাহ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘শাহ বদর আলম’ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের বদরপট্টি বা বদরপটিতে বদর আউলিয়ার মাজার অবস্থিত। বদর শাহর নাম বাংলাদেশের মাঝি-মাল্লার কণ্ঠে আজও সমস্বরে উচ্চারিত হয়—‘আমরা আছি পোলাপান,/আল্লাতালা নিগাবান/আল্লাহ, নবী, পাঁচ পীর; বদর; বদর। ’ অথবা ‘বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো,/বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো/হেঁইয়ো… হেঁইয়ো…। ’
লেখক : বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
Leave a Reply