ব্যক্তিগত চেম্বারে বাড়তে পারে বৈষম্যও , সেবা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৩
  • 170 পাঠক

দৈনিক দিশারী ডেস্ক

——————-
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকদের ‘ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ অর্থাৎ ফি নিয়ে রোগী দেখার ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে আলোচনা ছিল। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন।

তারা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সেবা উল্টো ব্যাহত হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই ব্যবস্থা বৈষম্যও বাড়াবে।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে কর্মঘণ্টা শেষে চিকিৎসকদের আর বাইরে ব্যক্তিগত চেম্বার, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে রোগী দেখতে হবে না। নিজ কর্মস্থলেই ব্যক্তিগত চেম্বার করতে পারবেন তারা। একেই বলা হচ্ছে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস।

এই ব্যবস্থা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিজের কর্মস্থলে বা বাইরে কোথাও প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস করেন, এমন নজির উন্নত দেশগুলোয় নেই। বরং তাদের অনেক বেশি বেতন দিয়ে ভালো চিকিৎসা দিতে উৎসাহ দেয়া হয়।

সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আগামী ১ মার্চ থেকে চিকিৎসকরা সরকারি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, সেখানেই তাদের জন্য চেম্বার করে রোগী দেখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেলা ২টার পর চিকিৎসকরা অন্যত্র চেম্বার খুলে রোগী দেখেন। সেটি বন্ধ করে তাদের কর্মস্থলেই চেম্বার খোলা হবে। এ বিষয়ে একটি কর্মপন্থা তৈরি হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। তবে সেটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে এখনো তা নির্ধারণ করা হয়নি।

তবে জানা গেছে, এ বিষয়ক খসড়ায় ১৯ দফা দেয়া হয়েছে। সেখানে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজ হাপসাতালে রোগী দেখবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেশের ২০টি জেলা হাসপাতাল ও ৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে দেশের পাঁচটি মেডিকেল কলেজে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।

ইন্সটিটিউটশনাল প্র্যাকটিস এই প্রথমবারের মতো সরকারি সিদ্ধান্তে এলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সাল থেকেই তা চলছে। সেখানে বৈকালিক বহির্বিভাগে বেলা আড়াইটা থেকে বিশেষ টিকিট বিক্রি শুরু হয়। ২৬ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হাসপাতালের নির্ধারিত দায়িত্ব শেষে সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার বাদে বাকি পাঁচ দিন ২০০ টাকা ফিতে রোগী দেখেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসকরা ইন্সটিটিউট অর্থাৎ যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তার বাইরে গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসককে বিনা ফিতে দেখানো যায়, সেই চিকিৎসককে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে দেখাতে দিতে হয় হাজার টাকার বেশি। তারপরও সাধারণ মানুষ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোয় কর্মঘণ্টার পরে চিকিৎসকদের প্র্যাকটিস করার সিদ্ধান্তে অর্থের চেয়ে অনর্থই বেশি হবে। সুবিধার চেয়ে অসুবিধা হবে বেশি। সকালে চিকিৎসকরা কম টাকায় টিকিট কাটা সাধারণ রোগীদের দেখবেন। আবার যাদের সামর্থ্য আছে, তারা কর্মঘণ্টার পরে সেই চিকিৎসককেই একই হাসপাতালে বেশি টাকা দিয়ে দেখাবেন- বৈষম্যটা এভাবেই হবে। সকালের রোগীরা দরিদ্র আর বিকেলের রোগীরা ধনী। চিকিৎসা সেবায় এটা বৈষম্য তৈরি করবে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সবচেয়ে ভালো হয় যদি সরকারি হাসপাতালগুলোয় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা, আবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা- এভাবে দুই শিফটে সেবাব্যবস্থা চালু করা যায়। যদি কোনো চিকিৎসক সকাল ও বিকেল দুই শিফটেই কাজ করতে চান, তাহলে তাদের অতিরিক্ত সম্মানী দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি হতে হবে। এতে করে সাধারণ মানুষ একটি মানসম্পন্ন সেবা পাওয়ার সুযোগ পাবে।

একই হাসপাতাল, একই লজিস্টিকসসহ অনান্য আনুষঙ্গিক ব্যবহার করে কম টাকা এবং বেশি টাকায় রোগী দেখার বিষয়টি মনে হয় আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন চিকিৎসকের ভালো লাগবে না।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, কেবলমাত্র চিকিৎসকদের প্র্যাকটিস বাড়ানোর জন্য বিকেলে রোগী দেখার কথা বলা হচ্ছে। সেটা সফল হবে না এবং এটা গ্রহণযোগ্য বলেও মনে হচ্ছে না। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, যদিও দেশের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বেড়েছে, কিন্তু মান বাড়েনি।

এখন পর্যন্ত দেশে সমগ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থসেবা দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। এর জন্য প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি জনবলের সমন্বয়ে তা করতে হবে। অর্থাৎ দু-পক্ষ মিলেই সেটা হতে পারে। প্রতিবছর প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা পেতে ব্যয়ের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে থাকবে তিনজন নার্স এবং পাঁচজন টেকনিশিয়ান। কিন্তু বাংলাদেশে দুজন চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছে একজন নার্স; টেকনিশিয়ান আরও কম। অর্থাৎ মানসম্মত সেবা দেয়ার জন্য যেসব কাজ করা দরকার, সেগুলো হচ্ছে না। এসব পরিকল্পনা না করে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মতো এমন সিদ্ধান্তে মানুষের কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে না।

এই সিদ্ধান্ত সরকার কেন নিতে চাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না- মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুরোটাই ধোঁয়াশা। এই সিদ্ধান্তে জনগণ, চিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী লাভ হবে সেটা স্পষ্ট না। কারণ কোনো বিশেষজ্ঞকে এ নিয়ে জোর করা যাবে না, পুরোটাই তাদের ঐচ্ছিক বিষয়।
কিন্তু সরকারি হাসপাতালের তুলনায় তারা বেসরকারি হাসপাতালে সুবিধা বেশি পায়। ডাক্তারদের উপজেলা পর্যায়েই নেয়া যায় না, তাহলে এখানে থাকবে কেন?

অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, এমনিতেই সরকারি হাসপাতালগুলো ওভার বার্ডেন্ডেড, ওভার ক্রাউডেড। মানুষকে মাসের পর মাস একেকটা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে কেবল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া রোগীরা আর কোনো সুবিধা পাবে না। কারণ পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি নেই হাসপাতালে। আদতে সরকার এই সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাচ্ছে সেটা কেবল তারা ছাড়া আর কারও কাছে বোধগম্য নয় বলেই মনে হচ্ছে।

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বেবিদ্যালয়ের বৈকালিক বহির্বিভাগের চিকিৎসা সেবা আদতে কতটুকু ফলপ্রসূ কিংবা রোগীবান্ধব হয়েছে, সেটা পর্যালোচনা কিংবা মূল্যায়ন না করেই সরকারি হাসপাতালগুলোয় এই প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করার মতো সিদ্ধান্ত একদমই ঠিক নয়।
তিনি বলেন, শুরুতে যখন সেখানে এই সার্ভিস চালু হয়, তখন কিন্তু সবার অনেক আগ্রহ ছিল। অনেক ইতিবাচক কথা আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু তার কতটা এখন বাস্তবে রয়েছে, সেটা দেখা দরকার। সত্যি হচ্ছে, এই সেবা কার্যকর হয়নি। এটাই হওয়ার কথা ছিল।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!