মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
——————–
আল্লাহ তাআলা ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বিন হিসেবে নির্বাচন করেছেন। মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে একমাত্র তাঁর ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশনার মধ্যে মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সব কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত আছে। তাই ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিসরে একজন মুসলিমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি যেন তারা একমাত্র ইবাদত করে।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
রাষ্ট্র পরিচালনায় কোরআনের নির্দেশনা : আমানত তথা অন্যের প্রাপ্য যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সর্বোপরি কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা একজন দায়িত্বশীলের প্রধান কর্তব্য। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে দায়িত্বশীলদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা আমানত হকদারের কাছে অর্পণ করো। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে, আল্লাহ তোমাদের কতই না উত্তম উপদেশ দেন, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী, তোমাদের কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও রাসুলের কাছে উপস্থাপন করো, এটাই উত্তম ও পরিণামে সুন্দরতর।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৯-৫৮)
শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব : শরিয়তের দৃষ্টিতে একজন নেতা নির্বাচন আবশ্যক। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর সাহাবিরা আবু বকর (রা.)-এর কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে শপথ গ্রহণের জন্য এসেছিলেন। এর পর থেকে সব যুগে মানুষের বিভিন্ন বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য কাউকে নিযুক্ত করার নিয়ম চলে আসছে। কখনো মানুষকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হবে না। (মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা : ২৯১)
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্ব তুলে ধরে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘এ কথা জানা জরুরি যে সমাজে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দ্বিনের আবশ্যকীয় বিধানগুলোর অন্যতম। বরং এটি ছাড়া দ্বিনের অস্তিত্ব থাকে না। কারণ পারস্পরিক প্রয়োজন পূরণে আদমসন্তানের ঐক্য ছাড়া সমাজের কল্যাণ সম্ভব নয়। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, তিনজন ভ্রমণে বের হলে তারা যেন একজনকে প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে।’ (আস-সিয়াসা আশ-শরইয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ২০)
কোরআনে বর্ণিত দুই মুমিন শাসক : পবিত্র কোরআনে দুজন শাসকের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশিষ্ট তাবেঈ মুজাহিদ (রহ.) থেকে ইবনে কাসির (রহ.) বর্ণনা করেছেন, চার ব্যক্তি পৃথিবী শাসন করেছেন। এর মধ্যে দুজন মুমিন ও দুজন কাফির। মুমিন দুজন হলো সুলাইমান (আ.) ও জুলকারনাইন (আ.)। কাফির দুজন হলো নমরুদ ও বুখতেনসর। (তাফসিরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা : ৩১৪, খণ্ড : ১)
মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্ব সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুলাইমান (আ.) ছিল দাউদ (আ.)-এর উত্তরাধিকারী, সে বলেছিল, হে মানুষ, আমাকে পাখিদের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। সুলাইমানের সামনে তার বাহিনী জিন, মানুষ ও পাখিদের সমবেত করা হয়, তাদের বিভিন্ন ব্যূহে বিন্যস্ত করা হয়।’ (সুরা : নামল, আয়াত : ১৯)
অন্য শাসক জুলকারনাইন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে তার বর্ণনা দিচ্ছি। আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং সব বিষয়ে উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৮৫)
ইসলামে দায়িত্ব অর্পণের রূপরেখা : ইসলামী শরিয়তে যেকোনো দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। জনসাধারণের যেকোনো কাজে দায়িত্বশীল নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যদের প্রাধান্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে আমানতদারির নির্দেশনা এসেছে। যেমন—পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.)-এর বিশ্বস্ততা প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্যত্র শাসনকার্যে ইউসুফ (আ.)-এর নিয়োগ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাজা বলল, ইউসুফকে আমাদের কাছে নিয়ে আসো, তাকে আমি একান্ত সহচর নিযুক্ত করব, অতঃপর তাঁর সঙ্গে কথা বলে রাজা বলল, আজ আপনি আমাদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৪)
দায়িত্বশীলদের কল্যাণ কামনা : আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা পালনকারী দায়িত্বশীলদের অনুসরণ করা সাধারণ মুসলিমদের কর্তব্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তোমাদের তিনটি বিষয় পছন্দ করেন এবং তিনটি বিষয় অপছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন তোমরা একমাত্র তাঁর ইবাদত কোরো, তাঁর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করবে না এবং আল্লাহর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে, বিভেদ করবে না এবং আল্লাহ যাদেরকে তোমাদের দায়িত্বশীল করবেন, তাদের জন্য কল্যাণ করবে। তিনি অপছন্দ করেন তোমাদের অনর্থক কথাবার্তা, সম্পদের অপব্যয় ও মানুষের কাছে বেশি বেশি চাওয়া। (মুসলিম, হাদিস : ১৭১৫)
শাসকদের জন্য সুসংবাদ : ন্যায়পরায়ণ শাসকদের জন্য ইহকাল ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। ইয়াদ বিন হিমার আল-মুজাশেয়ি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, জান্নাতে তিন শ্রেণির লোক থাকবে। ক্ষমতাসীন ন্যায়পরায়ণ শাসক, মুসলিম ও আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ এবং বড় পরিবার নিয়ে যিনি নিষ্কলুষ পবিত্র জীবন যাপন করেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৮৬৫)
অন্য হাদিসে উত্তম শাসকদের মর্যাদার কথা এসেছে। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের উত্তম ও নিকৃষ্ট শাসকদের সম্পর্কে জানাব না? উত্তম শাসক হলো যাদের তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদের ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দোয়া করো এবং তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করে। নিকৃষ্ট শাসক হলো যাদের তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদের অভিশাপ দাও এবং তারাও তোমাদের অভিশাপ দেয়। (তিরমিজি, হাদিস : ২২৬৪)
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ (কিয়ামতের দিন) সাত শ্রেণির মানুষকে (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। সেদিন তার ছায়া ছাড়া কোনো ছায়াই থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ শাসক। আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে ওঠা যুবক। মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর যার অন্তর মসজিদে সম্পৃক্ত থাকে, যতক্ষণ না সে তাতে ফিরে আসে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে; তাঁর সন্তুষ্টির জন্য একত্র হয় এবং তাঁর জন্য বিচ্ছিন্ন হয়। যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়। মর্যাদাবান সুন্দরী নারী ডাকার পর যে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। যে এমনভাবে দান করে, তার ডান হাত জানে না বাঁ হাত কী খরচ করেছে। (বুখারি, হাদিস : ৬৮০৬)
Leave a Reply