সমাজে প্রচলিত ১০টি সুদি লেনদেন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
  • 129 পাঠক

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

———————-

সুদের প্রধান দুই প্রকারের একটি রিবা নাসিয়া। ইমাম আবু বকর জাসসাস (রহ.) বলেন, এমন ঋণ যাতে মেয়াদ শর্ত করা হয় এবং গ্রহীতাকে অতিরিক্ত প্রদানের শর্ত করা হয়। (আহকামুল কোরআন ১/৫৫৭)

অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে কাউকে মেয়াদি ঋণ দেয়া। রিবা নাসিয়ার আরেক প্রকার হলো, রিবাদ-দাইন।

রিবাদ-দাইন হলো কারো থেকে কোনো পণ্যের বিক্রিলব্ধ বকেয়া-মূল্য পরিশোধের সময় হলে, তখন অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া। অর্থাৎ অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের শর্তে সময় বাড়িয়ে নেওয়া। বর্তমানে এই উভয় ধরনের রিবা নাসিয়া (ঋণভিত্তিক সুদ) সমাজে প্রচলিত। নিম্নে এমন কয়েকটি সুদি লেনদেন তুলে ধরা হলো, যেগুলোকে অনেকেই সুদ মনে করে না।

১. লটারি : বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের লটারি ছাড়ে। এসব লটারিতে লাখ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পুরস্কার পায় কয়েকজন। অন্যদের টাকা গচ্ছা যায়। এ ধরনের লেনদেনকে শরিয়তের ভাষায় ‘কিমার’ বলে। যা সম্পূর্ণ হারাম। আর এ ক্ষেত্রে সবাই তো অতিরিক্ত পাওয়ার উদ্দেশ্যেই ১০-২০ টাকায় লটারি কেনে। যদিও কেউ পুরস্কার পায় আর কেউ পায় না। তাই এতেও সুদ বিদ্যমান।

২. জমি বন্ধক : বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় বহুল প্রচলিত লেনদেন হলো, জমি বন্ধক রীতি। জমির মালিক একটা মোটা অঙ্কের টাকা নেয়। বিনিময়ে বন্ধক গ্রহীতা জমিটি ভোগ করে এবং মেয়াদান্তে মালিক পুরো টাকা ফেরত দিয়ে জমিটি বুঝে নেয়। এ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার জন্য বন্ধকি জমি ভোগ করা রিবা নাসিয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা হারাম। কোনো কোনো এলাকায় এটাকে জমি কট দেওয়াও বলে। আবার কেউ জমি খায়খালাসি দেওয়া বলে। নাম যা-ই হোক লেনদেন এবং হুকুম একই।

৩. বাড়ি বন্ধক : জমি বন্ধকের মতো ঢাকা শহরে বাড়ি বন্ধকের প্রথা চালু হয়েছে। তা হলো বাড়িওয়ালা নিজ প্রয়োজনে পাঁচ বা ১০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। বিনিময়ে পাঁচ বছর বা ১০ বছর ঋণদাতাকে তার ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকার সুযোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে যখন ঋণ পরিশোধ করে দেবে তখন এই চুক্তি সমাপ্ত হবে। এই লেনদেনও সম্পূর্ণ সুদি ও রিবা নাসিয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা সুস্পষ্ট হারাম।

৪. সিকিউরিটি বেশি দিলে ভাড়া কমিয়ে দেওয়া : বাড়ি বন্ধকের উপরোক্ত পদ্ধতি নাজায়েজ হওয়ার কারণে অনেকে হিলা (কৌশল) হিসেবে এই পদ্ধতি চালু করেছে। যেমন কোনো বাড়িওয়ালার টাকার প্রয়োজন। যেখানে সাধারণ হিসেবে অগ্রিম নেওয়ার কথা ২০ হাজার টাকা; তার পরিবর্তে বাড়িওয়ালা পাঁচ লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি দাবি করে এবং এর বিনিময়ে ভাড়া কমিয়ে দেয়। এটাও হারাম। কেননা পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কারণেই মূলত তার থেকে ভাড়া কম নিচ্ছে। এই ঋণকে অজুহাত হিসেবে সিকিউরিটি মানি বলা হয়েছে।

৫. ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ড : সরকারি বা বেসরকারি ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ড সুদি ফান্ড। ঐচ্ছিক হওয়ার কারণে এতে টাকা জমা দেওয়ার অর্থ ঋণ দিয়ে পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত নেওয়া। আর এটাই রিবা নাসিয়া। আর পুরো সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বাধ্যতামূলক যে অংশ এই ফান্ডে কেটে রাখা হয় এবং পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে অতিরিক্ত যে অংশ দেওয়া হয় তা সুদ নয়। তা নেওয়া জায়েজ।

৬. লাভের হার নির্ধারণ না করে বিনিয়োগ করা : ব্যাংক ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য টাকা প্রদান করে লাভ হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার শর্ত করা হয়। এটাও সম্পূর্ণ সুদি লেনদেন ও সুদি বিনিয়োগ। ব্যবসার জন্য দেওয়া আর লাভ দেওয়ার কথা হলেই অনেকে মনে করেন তা ইসলামী হয়ে যায়; সুদি থাকে না। অথচ ব্যবসার জন্য টাকা দিয়ে নির্ধারিত অঙ্কের কিছু দেওয়ার চুক্তি বা শর্ত করাই সুদ ও রিবা নাসিয়া। হালালভাবে বিনিয়োগ করতে চাইলে ব্যবসার প্রকৃত লাভের শতকরা হার নির্ধারণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে লাভ হলে নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী ভাগ পাবে। আর লাভ না হলে পাবে না।

৭. জুয়েলারি দোকানে স্বর্ণ বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া : জুয়েলারি দোকানে স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদের ওপর লোন প্রদান করা হয়। তেমনিভাবে গ্রামে নানা ধরনের সমিতির নামে সুদের ভিত্তিতে লোকদের ঋণ দেয়। এগুলো সবই রিবা নাসিয়া।

৮. ফরম বিক্রির নামে সুদ : কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সোসাইটি মানুষকে সুদবিহীন লোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের নিয়ম হলো, ঋণের পরিমাণ অনুযায়ী ফরম কিনতে বাধ্য করা হয় আর ঋণের হার অনুযায়ী ফরমের দাম কম-বেশি হয়। যেমন ১০ হাজার টাকা ঋণের জন্য পাঁচ শ টাকার ফরম ক্রয় করতে হয়। আর ২০ হাজার টাকার জন্য এক হাজার টাকার ফরম ক্রয় করতে হয়। আর নির্ধারিত মেয়াদের ভেতর তা পরিশোধ না করলে পরে আবারও আরেকটি ফরম ক্রয় করে পূরণ করতে হয়। বাহ্যিকভাবে এটি ফরম ক্রয়-বিক্রয়। কিন্তু এর মাধ্যমেই সুদ আগাম আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। এ জন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লে ফরমের মূল্যও বাড়তে থাকে। এটা হচ্ছে রিবা নাসিয়া গ্রহণের বাহানা মাত্র।

৯. কিস্তি-বিক্রি : বাজারে ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি ইলেকট্রনিকস সামগ্রী কিস্তিতে বিক্রি হয়। এই বিক্রির চুক্তিপত্রের মধ্যেই উল্লেখ থাকে। সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ বাড়বে। এটা রিবাদ-দাইন ও রিবা নাসিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাই এ ধরনের শর্ত সম্পূর্ণ নাজায়েজ। আর বাধ্য হয়ে কেউ এ ধরনের শর্তে ক্রয় করলে নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরই কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। নতুবা সুদ দেওয়ার গুনাহ হবে।

১০. ইনস্টাবাই : Instabuy বিভিন্ন কম্পানি ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারকে বিনা সুদে এবং অতিরিক্ত মূল্য ছাড়া দুই বা তিন কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয়। এতে কারবারটি সুদি কারবারে পরিণত হয়ে যায়। তাই ইনস্টাবাইয়ের সুবিধা গ্রহণ করলেও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় লেনদেন কারবার সুদি হয়ে যাবে। এটা রিবাদ-দাইনের অন্তর্ভুক্ত। (সংক্ষেপিত)

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সর্ব প্রকার সুদ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!