১১ হিজরির ২৮ সফর বুধবার রাতে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘বাকিয়ে গারকাদ’ কবরস্থান জিয়ারতে যান এবং কবরবাসীদের জন্য দোয়া করেন। দোয়ায় তিনি বলেন, ‘হে কবরবাসী! তোমাদের বর্তমান অবস্থা এবং কবরের অবস্থান কল্যাণকর হোক। কেননা, পৃথিবী এখন থেকে ফেতনার আঁধারে ছেয়ে যাবে।’ জিয়ারত শেষে ফেরার পর নবীজীর মাথাব্যাথা শুরু হয়। এরপর জ্বরও চলে আসে। -সিরাতে ইবনে হিশাম
বিশুদ্ধ বর্ণনানুযায়ী এই জ্বর ১৩ দিন স্থায়ী ছিল এবং এ অসুস্থতায় তিনি ইন্তেকাল করেন। -ফাতহুল বারি
নবী কারিম (সা.)-এর অসুখ ক্রমেই বাড়ছিল এবং একপর্যায়ে মসজিদেও যেতে পারছিলেন না। সে সময় তিনি হজরত আবু বকর সিদ্দিককে (রা.) নামাজের ইমামতি করতে নির্দেশ দেন। হজরত আবু বকর (রা.) নবী কারিমের (সা.) জীবদ্দশায় প্রায় ১৭ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করেন। -মিরকাত, শরহে মিশকাত
ঘটনাক্রমে একদিন হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আব্বাস (রা.) আনসার সাহাবিদের এক বৈঠকের পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন তারা দেখতে পান উপস্থিত সবাই কাঁদছে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ‘আমরা নবীজীর মজলিসের কথা স্মরণ করে কাঁদছি।’ হজরত আব্বাস (রা.) তাদের এই অবস্থার কথা নবীকে জানান। তিনি তখন হজরত আলি (রা.) ও হজরত ফজল ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কাঁধে ভর দিয়ে বাইরে বের হন। হজরত আব্বাস (রা.) তার আগে আগে যাচ্ছিলেন। নবী কারিম (সা.) মিম্বারে উঠতে চাইলেও অসুস্থতার কারণে উঠতে পারেননি; ফলে প্রথম সিঁড়িতে বসে পড়েন। এ সময় তিনি উপস্থিত সাহাবিদের সামনে অলংকারপূর্ণ এক ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি বলেন, ‘ হে লোকসকল! আমি জানতে পেরেছি যে, তোমরা তোমাদের নবীর মৃত্যুর ব্যাপারে ভয় করছ। তোমাদের জানা থাকা চাই, আমার আগে কোনো নবী কি চিরকাল থেকেছেন যে, আমিও থাকব ? হ্যাঁ, আমি আমার মহান রবের সঙ্গে শিগগিরই মিলতে যাচ্ছি এবং তোমরাও আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তবে তোমাদের সঙ্গে আমার মিলনের স্থান হচ্ছে হাউজে কাউসার। অতএব, যে এটা পছন্দ করে, কেয়ামত দিবসে সে হাউজে কাউসার দ্বারা পরিতৃপ্ত হবে, সে যেন আপন হাত ও মুখকে অনর্থক কাজ ও অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত রাখে। আমি তোমাদের মুহাজির ভাইদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং মুহাজিররা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা ও সদাচরণের অসিয়ত করছি।’
নবী কারিম (সা.) আরও বলেন, ‘ মানুষ যখন আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে, তখন তাদের শাসকরাও তাদের সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করে। আর যখন তার নির্দেশ অমান্য করে, তখন তাদের শাসকরাও তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করে।’ -সিরাতে মুহাম্মদিয়া
সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এই ভাষণ প্রদানের পর রাসুল (সা.) ঘরে ফিরে আসেন। ইন্তেকালের পাঁচ অথবা তিন দিন আগে আবারও তিনি ঘরের বাইরে বের হন। তখন তার মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। মসজিদে তখন হজরত আবু বকর (রা.) জোহরের নামাজের ইমামতি করছিলেন। নবীজীর আগমন টের পেয়ে হজরত আবু বকর (রা.) পেছনে সরে আসতে থাকলে তিনি তাকে হাতের ইশারায় নিষেধ করেন এবং নামাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি হজরত আবু বকরের (রা.) বাম পাশে বসে পড়েন। নামাজ শেষ হলে মুসল্লিদের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘ আমার প্রতি আবু বকরের অনুগ্রহ সবচেয়ে বেশি। আমি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আমার খলিল (বন্ধু) বানাতাম, তাহলে আবু বকরকেই বন্ধু বানাতাম ; কিন্তু আল্লাহ ছাড়া যেহেতু আমার কোনো খলিল হতে পারেন না, তাই আবু বকর আমার ভাই ও বন্ধু। ’ নবী কারিম (সা.) আরও বলেন, ‘আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদে আর যত দরজা রয়েছে, সব বন্ধ করে দাও।’
আল্লামা ইবনে হিব্বান (রহ.) এ হাদিসটি বর্ণনার পর বলেন, ‘ এ হাদিসে স্পষ্টভাবে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নবীজীর পর হজরত আবু বকরই খলিফা হবেন।’ -ফাতহুল বারি
২ রবিউল আউয়াল সোমবার। সেদিন হজরত আবু বকরের (রা.) ইমামতিতে লোকেরা ফজরের নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আয়েশার (রা.) কক্ষের পর্দা সরিয়ে লোকদের নামাজ পড়তে দেখে মুচকি হাসেন। হজরত আবু বকর (রা.) বিষয়টি টের পেয়ে পেছনে সরে আসতে লাগলেন। তখন আনন্দের আতিশয্যে সাহাবিদের মনও নামাজের মধ্যেই বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে নবী কারিম (সা.) হাতের ইশারায় নামাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি পর্দা ফেলে ঘরের ভেতরে চলে যান। এ ঘটনার পর তিনি আর কখনো বাইরে বের হননি। সেদিন জোহরের নামাজের পর নবী কারিম (সা.) দুনিয়ার এ জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হন। সহিহ বোখারির বর্ণনা অনুযায়ী তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। -ফাতহুল বারি
সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া অবলম্বনে।
অনুবাদ ইলিয়াস মশহুদ
Leave a Reply