কে ছিলেন মক্কা নগরীর স্বপ্নদ্রষ্টা ?

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, জুন ২২, ২০২৩
  • 176 পাঠক

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
২২ জুন, ২০২৩ 

——————–

একসময় মক্কায় কোনো পানির ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না খাবারের ব্যবস্থা। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে সেখানে কোনো মানুষের বসবাস ছিল না। মহান আল্লাহর নির্দেশে নবীদের নবী ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম মক্কা নগরী আবাদ করার উদ্যোগ নেন।

এবং তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে এখানে নিয়ে এসে রেখে চলে যান। মিসর থেকে ফিরে কেনানে আসার বছরখানেক পর ইবরাহিম (আ.)-এর প্রথম সন্তান ইসমাঈল (আ.)-এর জন্ম হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশুসন্তান ও তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ি উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহি নির্দেশ লাভ করেন। এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা।

অতঃপর ইবরাহিম (আ.) হাজেরা (আ.) এবং শিশু ছেলে ইসমাঈল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এ অবস্থায় যে হাজেরা (আ.) শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কাবার ঘর অবস্থিত, ইবরাহিম (আ.) তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের উঁচু অংশে জমজম কূপের ওপর অবস্থিত একটা বিরাট গাছের নিচে তাঁদের রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোনো মানুষ, না ছিল কোনো পানির ব্যবস্থা। পরে তিনি তাঁদের সেখানেই রেখে গেলেন।

আর এ ছাড়া তিনি তাঁদের কাছে রেখে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে কিছু পরিমাণ পানি। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল (আ.)-এর মা পিছু পিছু এলেন এবং বলতে লাগলেন, হে ইবরাহিম, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাদের এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোনো সাহায্যকারী, আর না আছে কোনো ব্যবস্থা। তিনি এ কথা তাঁকে বারবার বললেন। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) তাঁর দিকে তাকালেন না।

তখন হাজেরা (আ.) তাঁকে বললেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ। হাজেরা (আ.) বলেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না। অতঃপর তিনি ফিরে এলেন। আর ইবরাহিম (আ.)ও সামনে চললেন। চলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌঁছলেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তখন তিনি কাবাঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি দুহাত তুলে এ দোয়া করলেন, আর বলেন, ‘হে আমার রব, আমি আমার পরিবারের কতককে আপনার সম্মানিত ঘরের কাছে এক অনুর্বর উপত্যকায়…, যাতে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৭)

আর মা হাজেরা ইসমাঈল (আ.)-কে স্বীয় স্তনের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ওই মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজে তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তাঁর শিশুপুত্রটিও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুটির দিকে দেখতে লাগলেন। তৃষ্ণায় তার বুক ধড়ফড় করছে। সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের নিকটবর্তী পর্বত ‘সাফা’কে একমাত্র তাঁর নিকটতম পর্বত হিসেবে পেলেন।

অতঃপর তিনি তার ওপর ওঠে দাঁড়ালেন এবং ময়দানের দিকে তাকালেন। এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথায়ও কাউকে দেখা যায় কি না? কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন ‘সাফা’ পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। এমনকি যখন তিনি নিচু ময়দান পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের মতো ছুটে চললেন। অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের কাছে এসে তার ওপর ওঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর এদিকে-সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কি না? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন।

নবী (সা.) বলেছেন, এ জন্যই মানুষ এ পর্বত দুটির মধ্যে সাঈ করে থাকে। অতঃপর তিনি যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা করো। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছ। যদি তোমার নিকট কোনো সাহায্যকারী থাকে। হঠাৎ যেখানে জমজম কূপ অবস্থিত, সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে পানি বের হতে লাগল।

তখন হাজেরা (আ.)-এর চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে এক হাউসের মতো করে দিলেন এবং হাতের কোষভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। তখনো পানি উপচে উঠছিল। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে জমজমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন, যদি কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে জমজম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবহমান ঝরনায় পরিণত হতো।

অতঃপর হাজেরা (আ.) পানি পান করলেন, আর শিশুপুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোনো আশঙ্কা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর আছে। এ শিশু এবং তাঁর পিতা দুজনে মিলে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনো ধ্বংস করেন না। ওই সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি জমি থেকে টিলার মতো উঁচু ছিল। বন্যা আসার ফলে তার ডানে-বামে ভেঙে যাচ্ছিল। অতঃপর হাজেরা (আ.) এভাবেই দিন যাপন করছিলেন।

অবশেষে জুরহুম গোত্রের একদল লোক তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তারা ‘কাদা’ নামক উঁচু ভূমির পথ ধরে এদিকে আসছিল। তারা মক্কায় নিচু ভূমিতে অবতরণ করল এবং তারা দেখতে পেল, একঝাঁক পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয়ই এ পাখিগুলো পানির ওপর উড়ছে। আমরা এ ময়দানের পথ ধরে বহুবার অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখানে কোনো পানি ছিল না।

তখন তারা একজন বা দুজন ব্যক্তিকে সেখানে পাঠালো। তারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেল। তারা সেখান থেকে ফিরে এসে সবাই পানির সংবাদ দিল। সংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হলো। ইসমাঈল (আ.)-এর মা পানির কাছে ছিলেন। তারা তাঁকে বলল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদের অনুমতি দেবেন কি? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তবে এ পানির ওপর তোমাদের কোনো অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ, বলে তাদের মত প্রকাশ করল।

এ ঘটনা ইসমাঈল (আ.)-এর মাকে একটি সুযোগ এনে দিল। আর তিনিও মানুষের সাহচর্য চেয়েছিলেন। অতঃপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল এবং তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও সংবাদ পাঠাল। তারপর তারাও এসে তাদেরও সঙ্গে বসবাস করতে লাগল। পরিশেষে সেখানে তাদেরও কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হলো। আর ইসমাঈলও যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের থেকে আরবি ভাষা শিখলেন। যৌবনে পৌঁছে তিনি তাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। অতঃপর যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করলেন, তখন তারা তাঁর সঙ্গে তাদের একটি মেয়েকে বিবাহ দিল। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৪)

এভাবেই স্ত্রী জীবন-যুদ্ধ করে হাজেরা (আ.) পবিত্র মক্কা নগরী নির্মাণ করেন। বলা যায়, ইবরাহিম (আ.) মক্কা নগরীর স্বপ্নদ্রষ্টা। এবং তাঁর স্ত্রী হাজেরা এই নগরীর নির্মাতা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!