উম্মে আহমাদ ফারজানা। ০৯ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।
তাওয়াক্কুল অর্থ আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করা। ইবন রজব (রহ.) বলেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতের সব কাজে কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ প্রতিহত করতে আন্তরিকভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলা হয়। (ইবনু রজব, জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা ৪৩৬)
তাওয়াক্কুলের মূল কথা হলো অন্তর থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা করা, সেই সঙ্গে পার্থিব নানা উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহর হুকুম না হলে এই কাজ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। আর আল্লাহ চাইলে যেকোনো কাজ অবশ্যই সংঘটিত হবে।
যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। পবিত্র কোরআনে এসেছে, আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য বেরোনোর পথ বের করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন, যা সে ভাবতেও পারে না। আর যে আল্লাহর পর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ চূড়ান্তকারী।অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক কাজের জন্য একটা পরিমাপ ঠিক করে রেখেছেন। (সুরা : তালাক, আয়াত : ২-৩)।
তবে উপায়-উপকরণ গ্রহণবিহীন কোনো তাওয়াক্কুল নেই। কোনো কাজ সম্পন্ন করতে যে ব্যক্তি উপায়-উপকরণ অবলম্বনের কথা অস্বীকার করে, সে গণ্ডমূর্খ ও পাগল। আবার যে আল্লাহর কুদরতের ওপর ভরসা না করে শুধু উপায়-উপকরণ নিয়ে পড়ে থাকে তার আচরণ শিরকি।
আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি কি তাকে (আমার উষ্ট্রীটাকে) বেঁধে রেখে (আল্লাহর ওপর) ভরসা করব, না কি তাকে বন্ধনমুক্ত করে দিয়ে ভরসা করব? তিনি বলেন, আগে বেঁধে রাখো, তারপর ভরসা করো। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৭)।
অনেক সময় বান্দা আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায় না, অথচ দোয়া মুমিনের উত্তম অবলম্বন! আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁর বান্দাদের উপায় অবলম্বন করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি সেই মহান সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে অনুকূল করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার (ভূমির) বুকে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিজিক খাও। (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, তারপর যখন (জুমার) সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর দেয়া রিজিক অনুসন্ধান করবে, আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। সম্ভবত তোমরা সফল হবে। (সুরা : জুমা, আয়াত : ১০)।
ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর যুগে কিছু লোক দাবি করত যে তারা ভরসাকারী। তারা বলত, আমরা বসে থাকব, আমাদের খাওয়া-পরা দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর। তাদের উক্তি সম্পর্কে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা একদম মূর্খতাসুলভ কথা, আল্লাহ কি বলেননি, ‘…যখন সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করবে…। (ইবনুল জাওজি, তালবিসু ইবলিস, পৃষ্ঠা ৩৪৮)।
নবী করিম (সা.)-এর উপায়-উপকরণ গ্রহণ :
মহানবী (সা.) ছিলেন আল্লাহর ওপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী। তা সত্ত্বেও তিনি বহুক্ষেত্রে জাগতিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করেছেন তাঁর উম্মতকে একথা বুঝানোর জন্য যে উপায়-উকরণ গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। ওহুদের যুদ্ধে তিনি একটার পর একটা করে দুটি বর্ম গায়ে দিয়েছিলেন। সায়েব ইবনু ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে ওহুদ যুদ্ধের দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) দুটি বর্ম পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১৫৭৬০)।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছিলেন। আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয় দিবসে যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ ছিল। (বুখারি, হাদিস : ৪২৮৬)।
হিজরতের সময় তিনি একজন পথপ্রদর্শক সঙ্গে নিয়েছিলেন, যে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাত্রাপথে কোনো পদচিহ্ন যাতে না থাকে তিনি সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। এসব কিছু উপায় ও মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্গত। তিনি তাঁর উম্মতকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে উপায়-উপকরণ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর ওপর ভরসাকারী কোনো মুসলিমই উপায়-উপকরণ গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে পারে না।
ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথার্থভাবে ভরসা করতে তাহলে পাখ-পাখালির মতো তোমরা জীবিকা পেতে। তারা ভোর বেলায় ওঠে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে নীড়ে ফেরে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৪)।
এ হাদিসে উপায়-উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। যে পাখির খাবার জোগাড়ের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন সে তো তার কাছে খাবার আপনা থেকে আসবে সেই আশায় তার বাসায় বসে থাকে না, বরং খুব ভোরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করে দেন। ফলে সে যখন বাসায় েফরে তখন তার পেট ভরা ও পরিতৃপ্ত থাকে।
মহান আল্লাহ আমাদের উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে তাওয়াক্কুল করার তাওফিক দান করুন।
Leave a Reply