নোয়াখালীর অর্থনৈতিক জোনের জমিগুলো কার দখলে ?

  • আপডেট সময় শনিবার, নভেম্বর ২৫, ২০২৩
  • 165 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট ।২৫ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

মেঘনা থেকে জেগে ওঠা হাজার হাজার একর জায়গা অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে । আর এসব ভুমি দখলের মহৌৎসবে জেলার সব রাজনৈতিক দলের কর্তা ব্যক্তিরাও একট্রা ৷

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার সুবর্ণচরের চর উরিয়া, চর লক্ষ্মী, চর নোমান, চর বায়েজিদের বিস্তীর্ণ সরকারী ভূমিতে রয়েছে কথিত লক্ষ্মী এ্যাগ্রো ফিশারিজ ।

স্থানীয় সেলিম মাঝি জানান, এখানে জমির পরিমাণ কয়েক হাজার একর। অবশ্য ফিশারিজের নামে দখলে রাখা হলেও বাস্তবে পুরো জায়গাতে মাছ চাষেরই কোনো আলামত নেই ।স্থানীয় ভূমিহীন বেলাল ড্রাইবার জানান, লক্ষীএগ্রোর মালিক আল ফরিদের দখলে ছিল ১৫০০ একর। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিল তার একাধিপত্য।

লক্ষী এ্যাগ্রো ফিশারিজের দখলকালে অনেকগুলো ভূমিহীন পরিবারকে রাতারাতি বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান অনেকে । আল ফরিদের এক আত্মীয় বলেন, শুনেছি তিনি ওই জায়গার কিছু অংশ ফেনীর শাহজাহান ঠিকাদারের কাছে কয়েক কোটি টাকা বিক্রি করে দিয়েছেন।

এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৫৮ কথিত ফিশারিশ ও ব্যক্তিকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়। এরপর ২০০১ সালেও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলদার হিসেবে ৪৩টি দখলকারকে চিহ্নিত করেছিল। অবশ্য এতে থামেনি দখলদারদের দৌরাত্ম্য।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেঘনা অববাহিকার যেখানেই নতুন চর জাগে, সেখানেই শুরু হয় প্রভাবশালীদের দখল। দখলদারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা যেমন আছেন ; তেমনি আছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। আর এসব করতে দখলদাররা স্থানীয় মাস্তান ও চাঁদাবাজদেরও কিছু টাকা পয়সা দিয়ে হাত করে রাখেন।

অভিযোগ রয়েছে, দখলদারদের দৌরাত্ম্য চলে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায়। জানা গেছে, সরকারি হিসেবে মৎস্য খামারের নামে শুধু সুবর্ণচরে দখল হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৫৪ দশমিক ৬৭ একর। তবে অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দখল হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার একর।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) হিসেব অনুযায়ী, নোয়াখালীতে গত ৭০ বছরে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি ক্ষয় হলেও একই সময়ে নতুন করে এক হাজার বর্গকিলোমিটার যুক্ত হয়েছে।

নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত অ্যাকচুয়ারি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইডিপি) গবেষনা ও জরিপ কার্যক্রমে দেখা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নোয়াখালী উপকূলে ৫৭৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদী থেকে জেগে ওঠে। আবার একই সময়ে জেগে ওঠা ভূমির ১৬২ বর্গকিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে টিকেছে ৪১১ বর্গকিলোমিটার। এ হিসেবে বছরে গড় বৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার।

জেগে ওঠা নতুন চরের চিত্রটি সরেজমিনে দেখা গেছে, নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের বিভিন্ন নৌ-ঘাট কয়েক বছর পর পর কয়েক কিলোমিটার করে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা স্টিমার ঘাট (চার নম্বর ঘাট) থেকে সি-ট্রাক ছেড়ে যেতো হাতিয়ার দিকে। এখন এই ঘাট স্থানান্তরিত হয়েছে আরও অন্তত ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে।

পুরনো এ লঞ্চঘাট এলাকার আশপাশসহ চরআলাউদ্দিন, চরনোমান, চরবায়েজিদ, চরআক্রাম উদ্দিন, চর মকসেমুল পর্যন্ত নতুন জেগে ওঠা অনেক চর এখন চিংড়ি ঘেরসহ নানা প্রকল্পের নামে প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে।

চর দখল নিয়ে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন দুই রাজনৈতিক নেতা। তারা হলেন নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সাংসদ বরকত উল্যাহ বুলু ও সরকারদলীয় বর্তমান সাংসদ মামুনুর রশিদ কিরণ। তবে বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর দাবি, সুবর্ণচরে ১০০ একর তার নিজের কেনা জমি।

এছাড়া পারটেক্স গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য পদে থাকাবস্থায় কয়েক শত জমি দখলে নেন। তবে একটি সূত্র দাবি করছে, বুলু ও হাসেমের এসব জমি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় চেয়ারম্যান মহি উদ্দিন চৌধুরীর হাতে চলে যায়। গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশিদ কিরণের আটটি প্রকল্প আছে চরমজিদ এলাকায়। এসব প্রকল্পের সব জমিই সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত।

জানা গেছে, তার দখলে থাকা খাস জমির পরিমাণ ২০০ একর। তবে তার দাবি, তিনি এসব জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। এর বাইরে তার মালিকানাধীন কিছু জমি আছে। তিনি বলেন, পুরো জমিতে গাছ লাগানো, মাছ চাষ এবং ধান, সয়াবিন, সূর্যমুখী রোপণ করেছি।

মামুনুর রশিদ কিরণ তার জমির পরিমাণ ২০০ একরের মতো দাবি করলেও ২০০৫ সালের অক্টোবরে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মর্তুজা হোসেন মুন্সির নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সুবর্ণচর বিষয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, ওই প্রতিবেদনে মামুনুর রশিদ কিরণের গ্লোব ফিশারিজের দখলে ৪০০ একর এবং নোয়াখালীর আরেক শিল্পপতি মরহুম আনোয়ার মীর্জার আল আমিন গ্রুপের দখলে ৫০০ একর জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ এবং ফলদ, বনজ বৃক্ষসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু সরেজমিনে মীর্জার দখলীয় জায়গায় কিছু নারকেল গাছ ছাড়া ফলজ গাছের কোন অস্তিত্ব মেলেনি।আনোয়ার মীর্জার ভাই শামীম মীর্জার আল-বারাকা এ্যাগ্রো ফিশারিজের দখলে রয়েছে শতাধিক একর জমি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই জমি তারা ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ভূমিহীনদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে অর্জন করেছেন। তাদের দখলে রাখা এ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ ৯৮/৭২ এবং ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ৮৪ অনুযায়ী জমির সর্বোচ্চ সীমা লঙ্গন।

খাস জমির সুষ্ঠু বন্দোবস্তের জন্য ১৯৯৭ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এ নীতিমালা অনুযায়ী, এই ভূমি ক্রয়-বিক্রয় কিংবা হস্তান্তরযোগ্য নয়। কৃষি খাস জমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্তের ওই নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু ভূমিহীন পরিবারই খাস জমি বরাদ্ধ পাওয়ার অধিকারী।

চরনোমান ও চরবায়েজিদ এলাকায় ২০৭ একর জমি কিনে ঢাকা-নিউইয়র্ক এ্যাগ্রো ফিশারিজ নাম দিয়ে মাছের চাষ করছেন সোনাইমুড়ির খন্দকার রুহুল আমিন। তিনি আওয়ামী লীগের নোয়াখালীর সাবেক সভাপতি ও সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মরহুম মোহাম্মদ হানিফের বেয়াই।

আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের মরহুম এ সদস্য নিজেও চরনোমানে ৫০ একর জমিতে রাসেল এ্যাগ্রো ফিশারিজের দখলে রেখেছেন। অবশ্য এর মালিক তার ছেলে। এক এগারো সরকারকালে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদি আমিন আহমেদ ভূঞা ওরফে ডলার আমিনের দখলে আছে মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চরআলাউদ্দিন এলাকার ৩০০ একর জমি।

২০০৩-০৪ সালে বিএনপির আমলে এ জমি দখলে নেয়ার বিষয়ে তারা জানান, এ জমি তারা ২০ বছর আগে কিনেছেন।

এছাড়া স্থানীয় মহিউদ্দিন চৌধুরী চরআক্রাম উদ্দিনে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০ একর জমি দখলে নেন। তিনি সুবর্ণচরের মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান । চর দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি ক্রয়সূত্রে এসব জমির মালিক। এক সময় প্রতি একর জমি পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকায় কেনা যেত বলেও জানান তিনি।

সরেজমিনে অনুসন্ধানের সময় দেখা গেছে, চরনোমানে মোশারেফ গ্রামার মৎস্য খামারের নামে ১৪০ একর, নুরু মিয়া মৎস্য খামারের নামে ১৩০ একর, চরআলাউদ্দিনে আজাদ এ্যাগ্রো ফিশারিজের নামে ১১২ একর এবং চরআক্রাম উদ্দিনে বাইতুশ সাইফ মৎস্য খামারের নামে ১৫২ দশমিক ৫৫ একর, মৈত্রী এ্যাগ্রো ফিশারিজের নামে ২৬৮ দশমিক ৮৭ একর, লাদেন নামে এক ব্যক্তির দখলে ৪০০ একর জমি রয়েছে। বড় ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি চর দখলে পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগ নেতারাও।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, সুবর্ণচর উপজেলা ছাত্রলীগের একজনের দখলে চরআক্রাম উদ্দিনে ২০ একর, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আরেক নেতার দখলেও জমি আছে।

তবে তারা দাবি করছেন, এসব জায়গা তাদের বাপ-দাদার। একজন দাবি করেন, খাস জমি তো দূরের কথা, চরে ১০ একর জমির পুরনো দলিল তার ঘরে পড়ে আছে। সেই জমি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

এছাড়া জেলার কোম্পানীগঞ্জে একজন অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষকের দখলে রয়েছে প্রায় ৬০ একর। স্বনামে-বেনামে এসব জায়গা বন্দোবস্ত নিয়েছেন তিনি।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক জোন হিসেবে প্রস্তাবিত মোট জমির মধ্যে ১১ হাজার ৫৪ দশমিক ৬৭ একর চিংড়ি মহালের নামে দখল হয়ে গেছে। এ নিয়ে বেশ ক’টি মামলা ঝুলছে উচ্চ আদালতে। আইনগত জটিলতা শেষ না হলে এ জমি দখলদারদের কাছ থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!