দিশারী ডেস্ক। ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে মোবাইল ফোন। আঙুলের এক ক্লিকে চোখের সামনে নিমিষেই হাজির হয় হাজারো তথ্য। স্মার্ট ব্যাংকিং, ইউটিলিটি বিল ও জমির খাজনা পরিশোধ, আয়কর রিটার্নসহ হাজারো নাগরিক সুবিধাকে মানুষের হাতের কাছে নিয়ে এসেছে স্মার্টফোন। এর সুফল পাচ্ছেন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ।
তবে মুদ্রার উল্টোপিঠের মতো এই স্মার্টফোনের কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। এত সুবিধা নিয়ে আসা স্মার্টফোনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ভার্চ্যুয়াল জুয়ার দৌরাত্ম্য। তার আঁচ লেগেছে জেলা নোয়াখালীর সর্বত্রই।
থাই ও কালিয়ান নামে দুটি ওয়েবসাইটের (বেটিং সাইট) মাধ্যমে চলে ভার্চ্যুয়াল জুয়ার আসর। শহর ছাপিয়ে এই সাইটের ব্যবহার চলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে কিশোর-তরুণদের ভার্চ্যুয়াল জুয়ার এই সাইটে বুঁদ থাকতে দেখা যায়।
সচেতন মহল ও অভিভাবকরা বলছেন, উঠতি বয়সী ছেলেদের সারা দিন মোবাইল নিয়ে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়। শুরুর দিকে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও পরে জানা যায় তারা মোবাইলের মাধ্যমে বেটিং (ভার্চ্যুয়াল জুয়া) করছে। এই জুয়ার টাকা পেয়ে তারা মাদকসেবনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। চলমান এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করছেন তারা। তবে পুলিশ জানিয়েছে, জুয়ার বিস্তার রোধে তাদের নিয়মিত অভিযান চলমান আছে। তবে পুলিশের একার পক্ষে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন বলে জানানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নোয়াখালী শহরের সোনাপুর, মাইজদীসহ জেলার গ্রামীণ জনপদ ও প্রত্যন্ত এলাকায় জুয়ার প্রসার ঘটেছে। এসব সাইটের অধিকাংশই পরিচালিত হয় বিদেশ থেকে।
ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে এসব সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। জুয়ার মাধ্যমে লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা। নগদ টাকার আধিক্য থাকায় অনেক তরুণ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া ভার্চ্যুয়াল এই জুয়াকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠেছে একাধিক কিশোর গ্যাং; তারা জুয়ার টাকা জোগাড় করতে জড়িয়ে পড়ছে মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
থাই জুয়ায় আসক্ত আহাদ (ছদ্মনাম) জানান, এগুলো মূলত এক ধরনের লটারি। যারা এই জুয়া খেলেন তারা বিভিন্ন ধরনের লটারির টিকিট তৈরি করেন। এই টিকিটগুলোতে একটি করে নম্বর থাকে। এগুলোর ওপর বাজি ধরতে হয়। নম্বরের সঙ্গে মিলে গেলে জিতে যাওয়া টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করা যায়। এ ছাড়া লটারির টিকিট কেনার টাকাও মোবাইল ব্যাংকিং ও বেসরকারি কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়।
নিয়মিত জুয়ার আসরে অংশ নেয়া শহরের সোনাপুর এলাকার রাশেদ (ছদ্মনাম) বলেন, এগুলো থাইল্যান্ডভিত্তিক একটি বৈধ লটারি। স্থানীয় জুয়াড়িরা এই লটারির আদলে নিজেরা কিছু টিকিট তৈরি করেন। সেগুলো আবার থাইল্যান্ডের টিকিট দাবি করে বিক্রি করেন। তাদের বেশিরভাগ ক্রেতাই বিদেশি। তারা জুয়ায় অংশ নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। নোয়াখালী শহরে এই জুয়ার প্রাণকেন্দ্র কাজীপাড়া। এই পাড়ার অলি-গলিতে জটলা পাকিয়ে তারা জুয়া খেলেন।
মাধ্যমিকের পর লেখাপড়া ছেড়ে জুয়ায় আসক্ত হওয়া এক তরুণের বাবা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পাড়ার ছেলেদের সারা দিন মোবাইল নিয়ে জটলা করতে দেখি। প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম ওরা থাই জুয়া খেলছে। মহল্লার মানুষ ওদের কিছু বলতে ভয় পায়। কারণ ওরা সংগঠিত। কেউ কিছু বললেই সবাই মিলে হেনস্তা করে।
সচেতন ওই অভিভাবকের মতে, চোখের সামনে একটি প্রজন্ম জুয়ার ফাদে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কারণে পরিবারও নিঃস্ব হচ্ছে, অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না। জুয়াড়ি চক্রের সদস্যরা মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগই থাকছে অধরা। এ ব্যাপারে তিনি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
নোয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষক ও প্রফেসর কাজী মো. রফিক উল্যাহ বলেন, একটু একটু করে বেটিং খেলা থেকেই একসময় তরুণরা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় তারা বড় ধরনের জুয়াড়িতে পরিণত হন। এতে টাকার সংকটে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। ফলে এটি একদিকে যেমন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না।
অনলাইন জুয়া সম্পর্কে নোয়াখালী পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ নোয়াখালীতে অনলাইন জুয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। আমরা এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানও চালাচ্ছি। বেশ কিছু জুয়াড়িদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, শুধু পুলিশি অভিমানে এ জুয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এ জন্য এলাকাভিত্তিক সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, যারা অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকেই মাদককারবারি ও ভিসা প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
Leave a Reply