দিশারী ডেস্ক।। ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর হয়েও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন নোয়াখালীর বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব। সম্প্রতি তিনি সরকার ও জনস্বাস্থ্য প্রশাসনের উর্ধ্বতনমহলে চেষ্টা ও জোর তদবির করার মধ্য দিয়ে নোয়াখালীতে পূর্বের চেয়ারে স্থলাভিসিক্ত হওয়ার চেষ্টা ও জোর তদবিরের খবরে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে নোয়াখালীর নাগরিক সমাজে।
সূত্র জানায়, এর জন্যে সরকারের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ উর্ধ্বতনমহলকেও আর্থিকভাবে সুবিধা গেলানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
জানা যায়, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন কর্মস্থলে এবং বর্তমানে ঠাকুরগাঁয়েও নির্বাহী প্রকৌশলীর চেয়ারে বসে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত করছেন আহসান হাবিব।
সংঘটিত দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদের সক্রিয় দোসর এবং স্ত্রীর সাথে প্রতারণার ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক থাকা ব্যক্তি সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগে আজো প্রকৌশলী পদে কর্মরত থাকার ঘটনায় চরম হতাশ হয়েছেন তারা।
—————————————————————————————————————
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে এ প্রকৌশলী নিজ নামে ‘ হাবীবের প্রযোজনায় শেখ মুজিবের আত্মজীবনী পাঠ ‘ নামক একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন। ওই সময় আওয়ামী সরকারের একেকবার একেক মন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিতগতভাবে দেখা করে তোষণ করেছেন আহসান হাবিব।
————————————————————————————————————-
——————————————————————————————————————-
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে অত্যন্ত চতুরতার সাথে নতুন করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ফ্যাসিবাদের দোসরদেরর সঙ্গে একাধিক জায়গায় গোপনে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতোপূর্বে তিনি পাবনায় পাদাসীনকালে অর্থ লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় নিজের নামে একাধিক আয়কর নম্বর বানিয়েও প্রশাসনের চোখ এড়াতে কুটকৌশলের আশ্রয় নেন। তবে একটা পর্যায়ে সেসব করেও দুর্নীতি দমন কমিশনের জালে আটকে পড়েন। এজন্য তার বিরুদ্ধে পাবনায় দুর্নীতি কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এছাড়া তিনি কাজ না করে টাকা উত্তোলন, প্রকল্পগুলোয় নিম্নমানের ম্যাটারিয়াল সরবরাহ, ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশনবাণিজ্য আত্মীয়স্বজন ও নিজের নামে নামধারি ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠান খুলে কাজ ভাগিয়ে নেয়াসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্বেও তথ্য গোপন করে অননুমোদিতভাবে প্রকৌশলী আহসান হাবীব বিদেশ ভ্রমণ করেন। এমন ঘটনার সত্যতা তার পাসপোর্টেও রয়েছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তার গ্রামের বাড়িতে রয়েছে কয়েক একর জমির ওপর বিশাল বাগানবাড়ি। সাভার ও মোহাম্মাদপুরসহ রাজধানীতে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আহসান হাবীব আওয়ামী লীগের অত্যন্ত কাছের লোক ছিলেন। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতা হত্যায় তিনি ফ্যাসিবাদীগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপাষকতাও করেছেন বলে জানান তারা।
আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (রংপুর সার্কেল) আবুল কালাম আজাদ জানান, ঠাকুরগাঁও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বলে আমিও লোক মুখে শুনেছি। এর আগে, নানা অনিয়মের কারণে তাকে নোয়াখালী থেকে এখানে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে কাজ না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিল প্রদানের অভিযোগ ওঠেছে।
জানা যায়, আহসান হাবিব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নোয়াখালী জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালনকালীন, সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে হাতিয়া উপজেলায় একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এন কে কর্পোরেশন ২ কোটি ৯৯ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৫ টাকার কার্যাদেশ পায়।
———————————————————————————————————–
এ কাজের প্যাকেজে টেস্ট টিউবওয়েল, প্রোডাকশন টিউবওয়েল, ওভারহেড ট্যাংক, পাইপলাইন ও ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কার্যাদেশ ছিল। এ সকল কাজের ব্যয় ধরা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এন কে কর্পোরেশনকে দিয়ে এ সকল কাজ না করে নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে কাজের সম্পূর্ণ বিল ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদান করেন।
———————————————————————————————————-
এছাড়া ব্যক্তিজীবনে তার রয়েছে আরো বহু তুঘলকি কান্ড। সরকারি অনুমতি ছাড়া অননুমোদিতভাবে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। ডাক্তার সুমনা ইসলাম নামে এক নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তৃতীয় বিয়ে করে এবং তার ওরসজাত সন্তানের স্বীকৃতি চেয়ে ওই নারী তার প্রতানার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। যা সে সময়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
নেত্রকোনায় নির্বাহী প্রকৌশলী চলতি দায়িত্বে থাকাকালীন তার তৃতীয় স্ত্রী ডাক্তার সুমনা ইসলামের নামে বাসুকা কর্পোরেশন নামীয় লাইসেন্স করে ওই লাইসেন্সে স্ত্রীকে তারই স্বাক্ষরে নেত্রকোনায় ১ কোটি ৩১ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ দশমিক ৯০৬ টাকার নলকূপ বসানোর কার্যাদেশ দেন। এ কাজের জন্য প্রকৌশলী আহসান হাবিব তার তৃতীয় স্ত্রী ডাক্তার সুমনা ইসলামের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রকৌশলী আহসান হাবীব তার নিকটতম আত্মীয়দের নামে লাইসেন্স করে অধিকাংশ সময় সেই লাইসেন্সে কাজ দিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করেছিলেন। অন্য লাইসেন্সে কাজ দিলেও সেই ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করেন। এসব করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি।
—————————————————————————————————————
সূত্র জানায়, নামে, বেনামে এবং নিকট আত্মীয় স্বজনের নামে তিনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন।
সূত্র আরো জানায়, প্রকৌশলী আহসান হাবীব শুধু সরকারি অর্থ লুটপাটের ক্ষেত্রেই ভয়ঙ্কর নয়, পারিবারিক জীবনেও তিনি ভয়ঙ্কর। প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করা তার তৃতীয় স্ত্রী ডাক্তার সুমনা ইসলামকে তিনি গর্ভবতীকালিন অবস্থায় নানাভাবে শাররিক, মানসিক নির্যাতন করেছেন।
————————————————————————————————————–
তাছাড়া ডাক্তার সুমনা ইসলামের সাথে যৌথ মালিকানায় একটি ফ্ল্যাট কিনে প্রকৌশলী আহসান হাবিব আইনগত প্রক্রিয়ায় তার অংশ ডাক্তার সুমানা ইসলামকে বুঝিয়ে দিলেও ফের নানাভাবে মালিকানা দাবি করছেন।
ডাক্তার সুমনা ইসলামকে ফ্লাট থেকে উচ্ছেদ করতে হয়রানিমূলক মামলাসহ সন্ত্রাসী পাঠিয়ে জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে প্রকৌশলী আহসান হাবিব। এ বিষয়ে ডাক্তার সুমনা ইসলাম জীবনে নিরাপত্তা চেয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
ডা. সুমনা ইসলাম ইতোপূর্বে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আমি রাশিয়া থেকে এমবিবিএস পাসের পর ২০১৯ সালে পাবনা মেডিকেলে ইন্টার্নশিপ করি। ২০১৯ সালে পাবনায় থাকাকালে নোয়াখালী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব (৩৮) সঙ্গে পরিচয় হয়।
২০১৯ সালের ২ মার্চ সাক্ষাৎ করে আহসান হাবীব বিয়ের প্রস্তাব দেন। কথোকথনের একপর্যায়ে পরিবার সম্মতিতে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি বিয়ে করি। কিন্তু আহসান হাবীব তার প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন করেন, যা আমি জানতাম না। আমাদের বিবাহিত জীবনে কিছুদিন পর আহসান হাবীবের আচার-আচরণ সন্দেহ হয়। তার বাড়িতে যেতে চাইলে আহসান হাবীব বিভিন্ন ধরনের তালবাহানা করেন। তার নেত্রকোনার বাসভবনে আমি স্থায়ীভাবে তার সাথে বসবাস করতে চাইলে সে এটা সম্ভব না বলে জানায়।
পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, আহসান হাবীবের আগে আরও একটি বিবাহিত স্ত্রী (আরিফা পারভীন) আছে। সেখানে একটি ছেলে সন্তান এবং দ্বিতীয় স্ত্রী হুমায়রার রহমানের সঙ্গে সংসার জীবন চলমান ও দুটি সন্তান রয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে আহসাব হাবীবকে জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে শাররিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। আমি, আমার মা ও ভাই তার গ্রামের বাড়ি মহাদেবপুর, নওগাঁ গেলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমি, আমার মা ও ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করেন। এ ঘটনায় মহাদেবপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করি। মামলার পর তিনি আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন।
কিছুদিন পর কিন্তু সন্তান-সম্ভবা হওয়ার খবরে আহসান হাবীব আমার সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ দিতে থাকে, না করলে আমাকে ডিভোর্স দেয়ার হুমকি দেয়। তার তখনকার কর্মস্থল নেত্রকোনায় গেলে আমাকে ও আমার মাকে তালাবদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশের সহায়তায় নিজেদের উদ্ধার করি। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সি আর মামলা করি।
ডাক্তার সুমনা দাবি করে বলেন, শুধু আমি নই, আমার আহসান হাবীবের বিরুদ্ধে প্রথম স্ত্রী আরিফা পারভীন বিভিন্ন সময়ে মামলা দায়ের করেছিলেন। আহসান হাবীব সামাজিকভাবে শুধু দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের কথা স্বীকার করেন। আহসান হাবীব বিভিন্ন সময় আমার বাসায় সন্ত্রাসী পাঠিয়ে আমাকে ও আমার সন্তানকে প্রাণনাশের চেষ্টাও করেছেন।
——————————————————————————————————————-
ডা. সুমনা বলেন, বাসুকা করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠান খুলে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় ৯৩টি টিউবওয়েল বসানোর কাজ প্রদান করেন তিনি। এর সব কাগজপত্র করেন আমার নামে। একইভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী, শালী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে কাজ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
——————————————————————————————————————
নোয়াখালীর জনস্বাস্থ্যের বেশ কয়েকজন ঠিকাদার জানান, প্রতিটি কাজের বরাদ্ধ হতে প্রকৌশলী আহসান হাবিব নগদ সুবিধা ভাগিয়ে নিতেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে নানান অজুহাতে কয়েকজন ঠিকাদার থেকে হাওলাত টাকা নিয়ে তা আর ফেরত দেননি বলেও তারা অভিযোগ করেন।
এসব বিষয়ে আহসান হাবিবের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগকালে পরে কথা বলবেন বলে জানালেও ফের আর ফোন দেননি তিনি।
জেলাবাসী নোয়াখালীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সুনাম ও সুখ্যাতি বিনষ্টকারী এবং ফ্যাসিস্ট্য সরকারের প্রেতাত্ম প্রকৌশলী আহসান হাবিবকে ফের নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আসার চেষ্টা, তদবিরের খবরে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলছেন, নোয়াখালীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গৌরব সমুন্নত রাখতে প্রকৌশলী নামের এমন দুর্জনদের চাকুরিচ্যুতির স্থলে দুর্নীতিবাজ ও প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত প্রকৌশলী আহসান হাবিবকে পদায়ন কিংবা পদাসিনে দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁরা বিব্রতবোধ করছেন।
Leave a Reply