হৃদরোগে রিংবাণিজ্য

  • আপডেট সময় বুধবার, মার্চ ২৯, ২০২৩
  • 183 পাঠক

দিশারী ডেস্ক

———–
উত্তর বঙ্গ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক রোগী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে তার হার্টে দুইটি রিং (স্টেন্ট) স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে তার অপারেশন হবে। এমন অবস্থায় জটিলতা তৈরি হয়েছে রিং বা স্টেন্টের মূল্য নিয়ে।

ওই রোগীর ছোট ভাই জারদারি জানান, জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি) কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মডেলের রিংয়ের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে তালিকা টানিয়ে দিয়েছে। তালিকায় রিং বেদে দাম উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত স্টক না থাকার অজুহাতে প্রতিটি রিং তালিকা মূল্যে সরবরাহ করতে অনীহা জানিয়েছে। এমন অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে তার ভাইয়ের অপারেশন নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।

একাধিক হৃদরোগে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হার্টের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে পড়লে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার একটি পদ্ধতি হচ্ছে স্টেন্টিং বা রিং পরানো। এ পদ্ধতির জন্য প্রথমে এনজিওগ্রাম করে রক্তনালিতে ব্লক শনাক্ত করা হয়। সেখানে এক থেকে তিনটি পর্যন্ত ব্লক ধরা পড়লে রিং পরানোর পরামর্শ দেয়া হয়।

এই রিং সরবরাহ করার জন্য জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউটের ভেতরে অন্তত অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধিরা ঘুরে বেড়ান। অপারেশন থিয়েটার ছাড়াও ক্যাথল্যাবের আশপাশে অবাধে ঘুরে বেড়ান তারা। অথচ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মচারী ছাড়া ক্যাথল্যাবের অভ্যন্তরে অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ।

এ কাজে প্রতিনিধিরা সরাসরি রোগী বা তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন না। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে রোগী বা তার স্বজনদের কথা চূড়ান্ত হলে বিক্রয় প্রতিনিধিদের ডাকা হয়। এরপর সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণ করে রিং বিক্রি করা হয়।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক বিক্রয় প্রতিনিধি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, ‘ একটি রিং বিক্রি করিয়ে দেয়ার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে হাজার হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়। কমিশনের অর্থ কেউ নগদে নেন। আবার কেউ বিদেশ ভ্রমণে স্পন্সরের জন্য নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন হাসপাতালে যে চিকিৎসকরা রিং পরানোয় অবৈধ কমিশন নেন, তাদের ইউনিটে রোগী ভর্তি হলে বাড়তি দামে রিং কিনতে হয় রোগীদের। হাতেগোনা যে ক’জন চিকিৎসক কমিশন নেন না, তাদের ওয়ার্ডে রিং পরানো রোগীরা ভর্তিই হতে পারেন না।

জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউট হাসপাতালে হার্টের রিং সরবরাহকারী বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে রিংবাণিজ্যের এই কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। শুধু হার্টের রিং নয়, হৃদরোগে চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেলুন, পেসমেকার, গাইডওয়্যার, ক্যাথেটার, ভাল্ব, অক্সিজেনেটর ইত্যাদি নিয়েও অবৈধ বাণিজ্য চলছে।

হাসপাতালে বিভিন্ন স্তরে আঁতাত করে বাড়তি দামে নেয়া হয় একেকটি রিং। হার্টের রিংয়ের এমন বাণিজ্য ঠেকাতে জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি) কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মডেলের রিংয়ের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মূল্য তালিকা প্রকাশের পরও হৃদরোগে ইনস্টিটিউটে গোপনে রিংবাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক রোগীর স্বজনরা।

জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউটের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক জানান, কেবল রিং পরানোর জন্য বিশেষায়িত কোর্স ‘ফেলোশিপ অন ইন্টারভেনশন’ সম্পন্ন করা চিকিৎসকরা সুষ্ঠুভাবে কাজটি করতে পারেন।

জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউটে মাত্র পাঁচজন চিকিৎসক এ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এ অপারেশন শুধু তাদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হওয়ার কথা। অথচ হার্টে রিং পরিয়ে কমিশন নিচ্ছেন হাসপাতালের অন্তত অর্ধশতাধিক চিকিৎসক।

তিনি বলেন , স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্টের অধীনে তিন থেকে পাঁচ বছর হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়া রিং পরানোর কাজে হাত দেয়া উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, রক্তনালি সামান্য সংকুচিত হলেই চিকিৎসকরা রোগীকে রিং পরাতে প্রলুব্ধ করেন। যে সমস্যা মাত্র কয়েক হাজার টাকার বেলুন থেরাপিতে সমাধান করা যায়, তা সমাধান করতে রিং পরিয়ে আরো বাড়তি টাকা বেশি হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রিং পরানো নিয়ে কমিশন-বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও চিকিৎসক। শতাধিক চিকিৎসক ও বেশ কিছু রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে হৃদরোগে হাসপাতালের হার্টের রিংবাণিজ্য। দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পরই রিং বিক্রি হয়। রোগীকে একটি রিং পরানো বাবত অতিরিক্ত টাকা চিকিৎসককে কমিশন দেন ব্যবসায়ীরা। এতে রিংয়ের মূল্য বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ এ কমিশন-বাণিজ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের আরেক অধ্যাপক রিংবাণিজ্যের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে সরব রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি। রিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সরব থাকায় অনেক সহকর্মীও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, বিক্রয় প্রতিনিধি ও চিকিৎসকদের একটি চক্র অবৈধ রিংবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।

তাদের অবৈধ সমঝোতার কারণে গরিব ও অসহায় রোগীদের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে রিং কিনতে হচ্ছে। অসহায় ও গরিব রোগীরা অর্থাভাবে হার্টের চিকিৎসা নিতে পারছে না। এ বিষয়টি তাকে খুবই ব্যথিত করে। উচ্চমূল্যের কারণে হার্টের রিং লাগানোর সামর্থ্য অনেক রোগীর নেই। অথচ এই রিংয়ের দাম অনৈতিকভাবে দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশি রাখা হচ্ছে। নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে তিনি বিষয়টি লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন বলেও জানান। বিক্রয় প্রতিনিধি ও চিকিৎসক চক্রের অবৈধ রিং বাণিজ্যের বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগে ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক বলেন, বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে।

তবে ঢালাওভাবে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাউকে বাণিজ্য করতে দেয়া হবে না। যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি যতদিন পরিচালক হিসেবে আছেন, ততদিন রিং নিয়ে কাউকে বাণিজ্য করতে দেবেন না।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!