দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল ছাড়াই বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক

  • আপডেট সময় বুধবার, জুলাই ৭, ২০২১
  • 736 পাঠক

————————————————-

অনেক হাসপাতালে করোনা মহামারীর চিকিৎসা দেয়ার নামেও চলছে আরেক তামসা

————————————————–

নিজস্ব প্রতিনিধি, নোয়াখালী : বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা ও নীতিমালা ১৯৮২’র তোয়াক্কা না করে দক্ষ, পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও চিকিৎসা উপকরণ ছাড়াই চলছে নোয়াখালীর অনেক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ছোটখাটো আকারের হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনার সাধারণ অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এমনকি অনেক হাসপাতালে করোনা মহামারীর চিকিৎসা দেয়ার নামেও চলছে আরেক তামসা।

সূত্র জানায়, সক্ষমতা না থাকলেও অর্থের লোভে জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা ক্ষোভ।

অবশ্য, ইতোপূর্বে সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থায় জাল-জালিয়াতিপূর্ণতার সঙ্কট নিরসনে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবার মান, জনবল ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির নানা অভিযোগে সেসব নিম্নমানের হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বেসরকারী হাসপাতালে বিশেষায়িত ও স্পর্শকাতর ইউনিট খোলার জন্য ডাক্তার, নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি থাকা অত্যাবশ্যক।

কিন্তু, বেশির ভাগই সাধারণ অনুমোদন নিয়ে দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ছাড়াই বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা প্রদানের নামে রমরমা ব্যবসা খুলে বসেছে। ফলে ওসব হাসপাতালে সুচিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত‚্যকে কেন্দ্র করে অনাকাক্ষিত ঘটনাও ঘটছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও তেমন কোন কার্যকর পরিবর্তন হয়নি এসব হাসপাতালের।

অভিযোগ ওঠেছে, এ জেলার প্রায় বেসরকারী হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ ও পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা হয় না। প্রায় হাসপাতালে একজন সাধারণ চিকিৎসককেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাজিয়ে চালানো হচ্ছে সর্বরোগের চিকিৎসার কারবার।

অনেক হাসপাতালে আদৌ কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। নেই প্রয়োজনীয় সেবিকাও। আর যেসব সেবিকা আছেন, তাদের প্রায়জনেরই নেই কোন প্রশিক্ষণ। এ জেলার অনেক হাসপাতালে অনেক আয়াই সেবিকার পোষাক গায়ে লাগিয়ে অপরিমিত চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত খরচ করেও এসব হাসপাতালে কাঙ্খিত সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ ওঠেছে।

জানা যায়, একশ্রেণির দালাল ও সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সিন্ডিকেট করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। কোনো কোনো হাসপাতালে সেবিকারাই চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় বহন করছেন।

আবার কোন কোন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকলেও অন্য চিকিৎসক দিয়ে সিজার করানো হচ্ছে। এ কারণে তৃণমূলে ৫০ শতাংশ সিজার হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। এসব ত্রুটিপূর্ণ সিজারের কারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবন পরবর্তী সময়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে তাদের ফিরে আসার সম্ভবনা কম বলে গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান।

নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, রোগীকে ওঠা-নামানো, কাত করাসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। কিন্তু, এ জেলার প্রায় বেসরকারী হাসপাতালে এগুলো নেই।

তাঁরা বলেন, প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও কার্ডিয়াক মনিটর হিসেবে হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক, ইনফিউশন পাম্প স্যালাইনের সূক্ষাতিসূক্ষ মাত্রা নির্ধারণের জন্যে ইনফিউশন পাম্প যন্ত্র দরকার।

তাঁরা জানান, একটি উন্নত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগতভাবে হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র, সিরিঞ্জ পাম্প শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের সিরিঞ্জ পাম্প যন্ত্র, রক্ত দেয়ার আগে শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রার সমান করার জন্য ব্যবহৃত ব্লাড ওয়ার্মার যন্ত্র থাকা জরুরী।

পাশাপাশি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণের জন্যে এবিজি মেশিন থাকতে হবে।

তারা বলেছেন, জরুরী পরীক্ষার জন্য আইসিইউসির সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক। কিন্তু এ জেলার কোন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এসব ব্যবস্থার বালাই নেই। অনেক হাসপাতালের কাছে এসব নতুন শব্দ।

বিশেষজ্ঞরা জানান, জটিল রোগের চিকিৎসায় ও জরুরী প্রয়োজনে আইসিইউর সেবা নিতে হয়। চিকিৎসকেরাও এই সেবার কথা ব্যবস্থাপনাপত্রে লেখেন। কিন্তু খরচ করেও এ সেবা পাওয়া যায় না এ জেলার বেসরকারী হাসপাতাল সমূহে।

অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিযোগ করেন, বর্তমানে বেসরকারী হাসপাতালকে প্রায় মালিকই একটি ব্যবসায় পরিণত করেছেন। এগুলো কে কীভাবে চালাচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকা উচিত।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবদুস সাত্তার ফরায়েজী বলেন, মানহীন ও অবৈধ বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রোগী ভাগিয়ে চিকিৎসা বাণিজ্য করাই মূল উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, এ জেলায় যে পরিমাণ বেসরকরী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনেষ্টিক রয়েছে তার তিনগুণেরই নেই কোন অনুমোদন।

সচেতন নাগরিক করিম নুরী জানান, সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসক, সেবিকা ও আয়ারাও রোগী ভাগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে নির্ধারিত কমিশন পাচ্ছেন।

অথচ সরকারি আইন অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলোর এক কিলোমিটার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল থাকতে পারবে না। কিন্তু নোয়াখালীতে এই আইন কোনভাবেই না মেনে জেলার ২৫০ শয়্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে পাশে রয়েছে এক ডজনেরও বেশি বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক।

এই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অধিকাংশেরই মালিক ডাক্তার ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অভিযোগ ওঠেছে, মাসোয়ারা পাওয়ার কারণে চুপ থাকেন সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নোয়াখালীর সচেতন নাগরিক মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। এগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু খোঁজখবর না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে। ফলে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তারা করে না। সর্বত্রই সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি গড়ে ওঠা দালালনির্ভর এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এতে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

আবার তাদের কেউ কেউ অনুমোদনের জন্য আবেদন করেই ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। স্থায়ী ভিত্তিতে কোন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করা থাকে না। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে ওই সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রয়েছে গোপন সমঝোতা।

সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে দালাল চক্র। তাদের অমানবিক বাণিজ্যিক খেলার খপ্পরে পড়ে অপচিকিৎসার শিকার হয় অনেক রোগী। ভুল চিকিৎসার পাল্লায় পড়ে অকালে একের পর এক রোগীর মৃত্যু ঘটছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন ডা.মাসুম ইফতেখার বলেন, আমরা কোন হাসপাতালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!