নিজস্ব ডেস্ক
————
সম্প্রতি ব্রি ২৮ ও ২৯ ধানও তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে। উচ্চফলনশীল, আবার আগাম ওঠে যায়—এ দুই কারণে কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্রি ধান ২৮।
আর যেসব এলাকায় বোরোর পর রোপা আমন কিংবা এক ফসলি হিসেবে শুধু বোরো চাষ হয়, সেসব জমির জন্য ব্রি ২৯ জাতটি জনপ্রিয়তা পায়। দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় প্রায় তিন দশক ধরে অর্থাৎ ১৯৯৪ সাল থেকে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত জাত দুটি। এরপর আরো অনেক ধান স্বীকৃতি পায়, কিন্তু কোনোটিই এ দুটির মতো দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারেনি।
জানা গেছে, অকালবন্যার আতঙ্কে থাকেন হাওরের কৃষক। এ কারণে তারা আগাম জাতের ধানের দিকে ঝোঁকেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি দেশীয় জাতের ধানই ভরসা। কিন্তু এগুলোর ফলন তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক উচ্চফলনশীল জাতেই বিকল্প খোঁজেন। তুলনামূলকভাবে আগে ওঠায় ব্রি ২৮ই তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয়।
কয়েক বছর ধরে এ জাতের ধান চাষ করে যেমন ভালো ফলন পেয়ে আসছেন, তেমনি বন্যা আসার আগেই ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। কিন্তু গত বছর হাওরের কিছু এলাকায় এ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। এবার আক্রমণটা সবচেয়ে বেশি। হাওরাঞ্চলের পাশাপাশি তুলনামূলক নিচু জেলাগুলোর কৃষকও চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি ২৮ ধান চাষ করে বেশ বিপাকে পড়েছেন। চিটা হয়ে যাওয়ায় অনেকে এবার ধানের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। কৃষি কর্মকর্তারা যদিও বলছেন, কয়েক বছর ধরেই ব্রি ২৮ ও ২৯ ধান চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বোরো আবাদ করা হয়েছে মোট ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭২ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাওরভুক্ত সাত জেলায় ৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। আর কয়েক সপ্তাহ পরই এসব অঞ্চলে শুরু হবে ধান কাটার উৎসব। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে হাওরের প্রায় ৪৪২ হেক্টর জমির ব্রি ২৮ ধান। ব্রি ২৯ জাতের ধানেও এবার রোগটি ছড়িয়েছে।
এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৭৭ হেক্টর, নেত্রকোনায় ৬৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪৫, সিলেটে ১০, মৌলভীবাজারে ৪৮, হবিগঞ্জে ৮৯ ও সুনামগঞ্জে ১০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এ সাত জেলার ৩৬৭ হেক্টর জমির ব্লাস্ট এরই মধ্যে দমন করা হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি।
খাদ্যে উদৃ্বত্ত জেলা নেত্রকোনায় এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। ভাটির এ জেলায়ও ব্রি ২৮ ধান লাগিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেক কৃষক। তাদেরই একজন খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষক শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ২৫ কাঠা জমিতে ব্রি ২৮ ধান রোপণ করেছিলাম। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে বেশির ভাগ জমির ধানই চিটা হয়ে গেছে।’ মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক জামাল মিয়া বলেন, ‘ব্রি ২৮ প্রতি কাঠায় (১০ শতাংশ) আগে যেখানে ছয়-সাত মণ হতো, চিটা হয়ে যাওয়ায় এবার হয়েছে দুই-তিন মণ।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, ‘জেলার হাওর উপজেলা মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও কলমাকান্দার কিছু এলাকায় ধানে চিটা হয়েছে। অধিক ফলনের আশায় অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ ও আবহাওয়াজনিত কারণেই এ বছর ব্রি ২৮ ধানে নেক ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ধান পাকা পর্যন্ত জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয়েছে ৭৩ হেক্টর জমি। তবে বোরো মৌসুমের শুরুতেই এ ধান আবাদ না করে কৃষকদের ব্রি ৮৮ ও ব্রি ৯৬ রোপণের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।’
সুনামগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪২টি হাওরের জমিতে এবার ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহিরপুর, মধ্যনগর, শাল্লাসহ অনেক এলাকার জমির ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। লোকসানের মুখে দিশেহারা কৃষক।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, হাওরবেষ্টিত এ জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যদিও চাষ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ৪৩ হাজার ২৭২ হেক্টর জমিতে ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ জাতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ বেশ ভাবিয়েছে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের। মধ্যনগর উপজেলায়ও একই অবস্থা। চিটা ও ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ফসল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এ বছরের খোরাকি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ব্রি ২৮ ধান আবাদ না করতে যে রকম প্রচার-প্রচারণার দরকার, কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তেমন প্রচার হয়নি। ফলে কৃষক বারবার একই ভুল করে লোকসানের মুখে পড়ছেন। শামছুদ্দিন নামে এক কৃষক বলেন, ‘বাজার থেকে ব্রি ২৮ ধানের বীজ কিনে রোপণ করেছি। কেউ তো আমাকে এ ধান আবাদ না করতে বলেনি। বললে আমরা এ ধান লাগাতাম না।’
সদরের লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক মো. কাউসার ভূঁইয়া জানান, তিনি এবার চার কেয়ার (৩০ শতাংশে এক কেয়ার) জমিতে ২৫ হাজার টাকায় রমজমা (বর্গা) নিয়েছেন। ধানের বীজ বপন, রোপণ, সার ও শ্রমিক বাবদ খরচ হয়েছে আরো ২০ হাজার টাকা। মোট ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে ধানের বদলে পেয়েছেন চিটা। ঋণ করে আবাদ করার পর এখন ঋণ শোধ নিয়েই চিন্তিত তিনি।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, ‘ব্রি ২৮ ছাড়াও স্থানীয় কিছু ধানে চিটা দেখা গেছে। এটি নিরসনের জন্য মৌসুমের শুরুতেই কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছি। বালাইনাশক প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এমনকি এ ধান চাষাবাদ না করতেও কৃষকদের বিভিন্ন উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভায় অনুৎসাহিত করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সুনামগঞ্জ অফিসের বীজ বিপণন শাখার উপসহকারী পরিচালক মো. আমিনুর রহমান বলেন, ‘ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ খুবই জনপ্রিয় জাতের ধান। এ ধান চাষ হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব নয়। আমরা অন্য জাতের ধান বাজারে এনেছি।’ তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান উর দৌলা জানান, বোরো ধানের জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার, দিনে গরম ও রাতে ঠাণ্ডা এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। তবে শুরুতেই এর প্রতিষেধক দিলে প্রতিরোধ করা যায়।
হাওরাঞ্চলেই শুধু নয়, দেশের অন্যান্য জেলায়ও ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত জমির পরিমাণ। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বারবাড়িয়া ও রাওনা ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি এলাকায় এ রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক। বারবাড়িয়া ও রাওনা ইউনিয়নের কৃষক ফরিদ আহমেদ, এনামুল হক ও নিজাম উদ্দিন জানান, প্রতিদিনেই বাড়ছে ব্লাস্ট রোগ। এভাবে বাড়তে থাকলে অনেক জমির ধান নষ্ট হয়ে যাবে। এ নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় আছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সাত হেক্টর জমি ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়েছে। আমরা কৃষি অফিস থেকে এ রোগের সতর্কীকরণের জন্য অনেক আগে থেকেই উঠান বৈঠক করে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি। তার পরও যেসব জমিতে এ রোগ দেখা যাচ্ছে তা তদারকির পাশাপাশি আর যাতে না ছড়ায় তার জন্য মাঠে থেকে কাজ করার জন্য উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ ধান জাত দুটি উদ্ভাবনের প্রকল্পপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. প্রণব কুমার সাহা রায়। তার অধীনে ড. তানভীর আহমেদ, ড. খাজা গুলজার হোসেন ও ড. কামরুন্নাহার কাজ করেন। ড. প্রণব কুমার সাহা রায় বলেন, ‘এ দুটি জাত অনেক আগের। ধীরে ধীরে পুরনো জাতে রোগ ধরে যায়। নতুন জাত এলে পুরনোগুলো এভাবেই কমে যাবে। এভাবেই একটি জাতের সম্প্রসারণ হয়।
দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য ব্রি ২৮ ও ২৯ অবদান রেখেছে। আগে এ দুই জাতে ব্লাস্ট বা অন্যান্য রোগ কম ধরত। রোগ প্রতিরোধীক্ষমতা ভালো ছিল, কিন্তু এবার হাওরাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েছি। এটা আবহাওয়াগত কারণে আক্রান্ত হয় সাধারণত। এ ভ্যারাইটিগুলো ব্লাস্ট রেজিস্ট্যান্স ছিল না। তবে নতুন নতুন ধানের জাত আসছে। সেগুলো ২৮ ও ২৯-এর জায়গা দখল করে নেবে।’
Leave a Reply