সিসাদূষণে দেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত

  • আপডেট সময় বুধবার, জানুয়ারি ১৭, ২০২৪
  • 214 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

বাংলাদেশে সিসাদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চিকিৎসকরা জানান, সিসাদূষণ-সংক্রান্ত রোগের প্রভাব ব্রংকিয়াল অ্যাজমা থেকে ২০ গুণ এবং ক্যানসার থেকে ১২০ গুণেরও বেশি। সিসার বিষাক্ততা শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং বিকাশকে ব্যাহত করে। প্রায় ৭০ শতাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্ব সিসার ফলে হয়ে থাকে।

সিসাদূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত প্রায় দুই লাখ মানুষ অকালে মারা যাচ্ছেন। এর কারণে শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এ ছাড়াও শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি শিশুদের কিডনি ও হার্টে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। পরিপাকতন্ত্রে সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ওজন কমে যাওয়া, খিঁচুনিসহ নানাবিধ রোগ হয়। গর্ভবতী মায়েদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির ফলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে।

ছোট মিশুকে নিয়ে খুবই চিন্তিত তার মা-বাবা। রাজধানীর এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে সে। মিশুর স্মৃতিশক্তি দুর্বল। পড়ালেখা নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ আসে স্কুল থেকে। তা ছাড়া ওর মধ্যে বেশ কিছু আচরণগত সমস্যা লক্ষ্য করছেন মা-বাবা। শ্রবণশক্তিও বেশ কমে গেছে বলেও ধারণা করছেন তারা। কিছুদিন ধরে মিশুর শরীর খুব খারাপ। বমি হচ্ছে, সঙ্গে মলের মধ্যে রক্ত এবং অনিয়মিত প্রস্রাব হচ্ছে। খাওয়ার রুচি নেই। চিন্তিত মা-বাবা মিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। বিভিন্ন টেস্ট করানোর পর ডাক্তার জানালেন ভয়ংকর তথ্য। কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়েছে ছোট মিশু। মিশুর শরীরে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটাই ওর কিডনিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘সিসা খুবই ক্ষতিকর পদার্থ। পরিবেশ দূষণ কিংবা যেকোনো খাদ্যের মাধ্যমে যদি সিসা কোনোভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে, তা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে লিভার, কিডনি এবং স্নায়ুর জন্য খুবই ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে তো আরও ভয়ানক বিপদ বয়ে আনে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সিসাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল হেলথ বার্ডেন অ্যান্ড কস্ট অব লেড এক্সপোজার ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টস: এ হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইকোনমিক মডেলিং অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে গবেষণাটি করেছেন বিশ্বব্যাংকের একদল গবেষক। এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসাদূষণে বাংলাদেশে বছরে হৃদরোগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪ মানুষ মারা যাচ্ছেন।

২০২০ সালে ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত ‘দ্য টক্সিক ট্রুথ: চিলড্রেন্স এক্সপোজার টু লেড পলিউশন আন্ডারমিন্স এ জেনারেশন অব পোটেনশিয়াল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সিসাদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।

বাংলাদেশে আনুমানিক ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটারের বেশি। প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি। অর্থাৎ এই শিশুদের বাঁচানোর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি, আর এসব শিশুদের প্রায় অর্ধেকই দক্ষিণ এশিয়ার।

বাংলাদেশের মানুষের সিসার সংস্পর্শে আসার মূল কারণ হিসেবে সিসাযুক্ত ব্যাটারির অবৈধ পুনর্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিসাযুক্ত ব্যাটারি রিসাইক্লিং শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটেছে। উন্মুক্ত বাতাসে এবং আবাসস্থলের কাছাকাছি এলাকায় এসব ব্যাটারির অবৈধ রিসাইক্লিং শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্যই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক রিসাইক্লিং কারখানা রয়েছে। নানা কারণে এ ধরনের কারখানা যখন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়, তখনও সেখান থেকে দীর্ঘদিন সিসাদূষণ ঘটতে পারে।

এ ছাড়াও দেশে মসলায় উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ওজন ও রং বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত লেড ক্রোমেট শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সমানভাবে রক্তে সিসার মাত্রা বাড়াতে অবদান রাখে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির বর্জ‍্য, খেলনা, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের হাঁড়িপাতিল, ভেজাল খাদ্যপণ্য, ওষুধ, কসমেটিকস এমনকি অনেক দিনের পুরোনো স্টিলের ট্যাপের পানিও মানবদেহে সিসাদূষণের মূল উৎস।

পিওর আর্থ তাদের গবেষণায় খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সিসার উপস্থিতি পরিমাপ করেছে। এগুলোর মধ্যে ২৪ শতাংশ নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। খাবার রাখার ৫৯ শতাংশ ধাতব পাত্রে, ৪৪ শতাংশ সিরামিক পাত্রে, ৯ শতাংশ প্লাস্টিকের পাত্রে, ৫৪ শতাংশ পেইন্টে, ১৭ শতাংশ চাল বা স্টার্চে, ১৩ শতাংশ খেলনায়, ৭ শতাংশ মসলায় এবং ৬ শতাংশ প্রসাধনীতে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

সিসাদূষণ সম্পর্কে শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘সিসা মানব শরীরের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও বিষাক্ত পদার্থ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে সিসা ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে। রক্তে সিসার উপস্থিতি শিশুর মেন্টাল ডিজঅর্ডার, অ্যানিমিয়া ও আচরণগত সমস্যার কারণ হতে পারে।

এ ছাড়া শরীরে সিসা জমা হতে থাকলে তা একসময় কিডনি ও হৃদরোগের প্রধান কারণ হতে পারে। সিসা নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণায় হলুদের গুঁড়ায় সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সে ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের জন্য আমার পরামর্শ, শিশুদের জন্য খিচুড়ি রান্না করার সময় যেন হলুদের গুঁড়া ব্যবহার না করা হয়। বড়দের ক্ষেত্রেও হলুদের গুঁড়া যত কম খাওয়া যায় তত ভালো।

সিসার দূষণ এত মাত্রায় বেড়ে গেছে যে, খাদ্যপণ্যও এ থেকে নিরাপদ নয়। ২০১৭ সালে ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা বাজারে তেলাপিয়া মাছে সর্বোচ্চ ১৬.৩৮৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

২০২১ সালে জার্নাল অব হেলথ অ্যান্ড পলিউশনে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সংগৃহীত প্রতি কেজি পাঙাশ মাছে ৩০.৮ মাইক্রোগ্রাম, রুই মাছে ১৫.৩৩ মাইক্রোগ্রাম ও কাতলা মাছে ১৫.৮৬ মাইক্রোগ্রাম সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে, গাছের পাতায় কীটনাশকের স্থায়িত্ব বাড়াতে, ডাইং হাউসের কাপড়ের রঙে এবং কলকারখানা থেকে নানা মাধ্যমে সিসা নদীতে পৌঁছায়। পরে সেটি মাছসহ নদীর প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে মানুষের পেটে।

আইসিডিডিআরবি ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১২-১৩ সালের দিকে বাংলাদেশের ৯টি জেলায় অন্তঃসত্ত্বাদের রক্তে সিসার পরিমাণ মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

তাদের ২০২২ সালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, দেশের সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিশু শরীরে ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। গবেষণায় বাজারের বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষা করা হয়। ৩৬৭টি পণ্যের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে ৯৬টিতে সিসার উপস্থিতি মিলেছে।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের (এসডো) করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সিসাজনিত দূষণের শিকার।

দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৭ হাজার ২২০ মেট্রিক টন শোভাবর্ধনকারী রং উৎপাদিত হয়। এর প্রায় ৯৮ ভাগ রঙে সিসার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এতে জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সিসাজনিত দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!