চিকিৎসার ব্যয়ে পিষ্ট মানুষ

  • আপডেট সময় রবিবার, মার্চ ২, ২০২৫
  • 34 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২ মার্চ, ২০২৫।

গবেষণা বলছে, সেবা নেয়া ৭৪ শতাংশ রোগীকে অতিরিক্ত খরচের বোঝা টানতে হয়। যার বড় অংশই যায় রোগ নির্ণয় ও ওষুধের পেছনে। অধিকাংশের অভিযোগ, চিকিৎসকরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনেন না। সেবা নিতে গেলেই বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয় ঘুষ।

২০২৩ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালের করা গবেষণায় এই চিত্র ওঠে এসেছে। গবেষণায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের পেছনে হাসপাতালের সুযোগের পাশাপাশি নিয়মবহির্ভূত অর্থ গ্রহণ, যাতায়াত ব্যয়, ওষুধ ও রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিতে গিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচকে যুক্ত করা হয়েছে।

বাড়তি এই ব্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে সক্ষমতার চেয়ে সেবাপ্রার্থী কয়েকগুণ বেশি হওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা আরও শক্তিশালী করার তাগিদ তাদের।

গবেষণায় বলা হয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতি চারজনের তিনজনকে সরকার নির্ধারিত সেবামূল্যের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে সেবা নিতে হয়। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। অতিরিক্ত এই খরচের হারকে অনেক বেশি বলে মনে করেন প্রায় ১৮ শতাংশ রোগী।

————————————————————————————

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধের অধিকাংশই নিতে হয় বাইরে থেকে। বাইরে রোগ নির্ণয়ের খরচ বেশি। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ লিখে দেন, তার ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশই রোগীকে কিনতে হয়।

————————————————————————————

উদ্বেগের বিষয়, সেবাপ্রত্যাশী প্রায় ৯৭ শতাংশ রোগীর অভিযোগ থাকে চিকিৎসক তাদের বক্তব্য শোনেন না। হাসপাতালগুলোতে ট্রলি বহনকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়ার্ডবয়দের বাধ্যতামূলক ঘুস দিতে হয় বলেও গবেষণায় ওঠে এসেছে।

দীর্ঘদিন ধরে পেট ও কোমর ব্যথাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা অটোরিকশা চালক ওয়াদুদ মিয়া (৪৫)। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসেন চিকিৎসা নিতে।

এ সময় সিআরপি, এসজিপিটি ও সেরাম ক্রিয়েটিনিনসহ পাঁচটি পরীক্ষা দেন চিকিৎসক। যার মাত্র দুটি সরকারি এই হাসপাতালে করতে পারলেও তিনগুলো করতে হয়েছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বিনামূল্যে ডাক্তার দেখাতে পারলেও রোগ নির্ণয়ে এবং ওষুধ কিনতে ওয়াদুদের ব্যয় করতে হয়েছে দুই হাজার ২৩০ টাকা। এর মধ্যে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই গেছে এক হাজার ৭০০ টাকা।

ওয়াদুদ বলেন, দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। মাত্র দুই মিনিটের মতো দেখেছেন তিনি। কথা শেষ না হতেই প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিনামূল্যে পাওয়া এতটুকুই। পাঁচটি টেস্ট দিয়েছেন। নমুনা দিতে গেলে বলে হাসপাতালে দুটি করা যাবে, বাকি তিনটি বাইরে করাতে হবে। শুধু কি তা-ই; ওষুধও ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। চার ধরনের ওষুধ দিলেও পেয়েছি মাত্র একটি। বাকিগুলো বাজার থেকে কিনতে হয়েছে।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে এমন বাড়তি ব্যয়ের বোঝায় চিড়ে চ্যাপটা হওয়ার কাহিনি শুধু ওয়াদুদের নয়। প্রতিদিন সেবা নেয়া লাখ লাখ রোগীর। স্বয়ং সরকারি গবেষণায় এ চিত্র ওঠে এসেছে।

গত বছরের শুরুতে রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে গবেষক দলের সদস্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আয়েশা আফরোজ চৌধুরী বলেন, সরকারি যা ব্যয় হচ্ছে, তারচেয়েও বেশি যাচ্ছে পকেট থেকে। তার মানে আমাদের সুযোগ-সুবিধা যদি পর্যাপ্ত থাকত, তাহলে এই বাড়তি ব্যয় রোগীর হতো না। পাশাপাশি কারণে-অকারণে রোগীকে বাইরে পাঠানোর একটি অনৈতিক চর্চাও পাওয়া গেছে গবেষণায়।

তিনি বলেন, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে আমরা ওষুধ দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। এছাড়া বিধিবহির্ভূত বকশিশ নেয়া অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। জনবল ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়মিত তদারকি হলে এ চিত্র অনেকটাই কমে আসবে।

———————————————————————–

খবর : ভিন্ন দৈনিক।

———————————————————————-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, সরকারি হাসপাতালে এই চিত্র দীর্ঘদিনের। সেবা নিতে গেলেই সেখানে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দুর্বল বলেই অধিকাংশ রোগী বিভাগীয় ও টারশিয়ারি হাসপাতালে চলে আসেন। এতে করে ব্যয় বাড়ছে।

চাপ নিয়ে চিকিৎসকদের রোগী দেখতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন একজন ডাক্তারের দেড়শ থেকে ২০০ রোগী দেখা লাগে। তাহলে কীভাবে তিনি সময় নিয়ে কথা শুনবেন। সরকারের আমলাদের কর্মস্থল অনেক পরিপাটি হলেও চিকিৎসকদের কর্মপরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। ফলে রোগী ও ডাক্তার উভয়েই এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ; কেউই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।

গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। ১২ সদস্যের কমিটি কয়েকটি ইউনিটে ভাগ হয়ে প্রায়দিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা সদর হাসপাতাল ও বিভাগীয় হাসপাতালের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করলেও প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি কমিশনের একাধিক সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সদস্য কে বলেন, সরকারি হাসপাতালে একেবারে কম খরচে মানসম্মত চিকিৎসা দিতে কমিশন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। ওষুধের সহজলভ্যতা ও সরকারি হাসপাতালে যাতে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, লোকবল এবং আনুষঙ্গিক যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোও পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। সে অনুযায়ী কমিশনের সদস্যরা মতামত দিচ্ছেন।

————————————————————————————

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের জুনে অপারেশন প্ল্যান (চতুর্থ এইচপিএনএসপি) শেষ হয়েছে। নতুন অপারেশন প্ল্যান এখনো শুরু হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা চেয়েছে। জনবলের জন্য নতুন করে স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ তৈরি হয়েছে। দক্ষ জনবল নিয়োগ হলে এবং চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা গেলে সংকটের কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

————————————————————————————

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। এত সামান্য বরাদ্দ দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, ডাক্তার ও নার্সসহ স্বাস্থ্যবিভাগীয় সব কর্মচারীর বেতন-ভাতা, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ওষুধ ও অন্যান্য কেমিক্যাল কিনতে হয়।

পাশাপাশি ক্রয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব তো রয়েছেই। আমাদের মতো গরিব দেশে সরকারি বাজেট দিয়ে দেশের সব মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয়। আমি মনে করি, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকলে আরো সুন্দরভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে।’

তিনি বলেন, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের নির্ধারিত শয্যার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ রোগী বেশি ভর্তি থাকে। যাদের বেশিরভাগই মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নেন। আবার চাহিদার তুলনায় যন্ত্রপাতির ঘাটতিও রয়েছে। অন্যদিকে বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক যদি রোগীকে ১৫ মিনিট সময় দেন, তাহলে সরকার নির্ধারিত সময়ে একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ ২৫ জন রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন। সেই চিকিৎসককে যদি দৈনিক ১০০ রোগী দেখতে হয়, তাহলে তিনি মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখতে পারেন না।

ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে সংকটের উত্তরণ হতে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। জয়নাল আবেদীন বলেন, একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে একটি শয্যা পাবেন— এটা তার অধিকার। এজন্য শয্যা অনুযায়ী রোগী ভর্তির নীতি চালু করতে হবে। আন্তঃবিভাগে প্রতি ১০ জন রোগীর জন্য প্রতি শিফটে একজন ডাক্তার না হলে ভালো সেবা দেয়া যায় না।

আমাদের সেবাগ্রহণকারীদের পাশাপাশি সেবাদানকারীরাও সন্তুষ্ট নন। এজন্য দরকার ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা। অবকাঠামো, প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি, ওষুধ, কেমিক্যালের নিয়মিত সরবরাহ, নিরাপদ কর্মস্থল, নিরাপদ আবাসন, বঞ্চনাবোধের অবসান ও জনকল্যাণের জন্য সেবাদানের মানসিকতা দরকার বলেও জানান তিনি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!