মারুফ মল্লিক
১২ মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের থাকা না–থাকা নিয়ে বিস্তর আলাপ–আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ নমনীয় অবস্থানে থাকলেও রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের আর ফেরার সুযোগ নেই বলে অনেকেই মনে করছেন। তাঁদের যুক্তি, গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আর দেশের রাজনীতি পুনর্বাসিত হওয়া সম্ভব নয়।
বারবারই দেশের মানুষের রক্তে আওয়ামী লীগের হাত রঞ্জিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের হাতেই দেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি খুন, হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এটা শুরু করেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগই প্রথম পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী দিয়ে হত্যা ও গুম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের একই অভ্যাস বজায় ছিল।
আওয়ামী লীগ সব সময়ই নিজ সমর্থক গোষ্ঠীর বাইরের অংশকে দমনের চেষ্টা করেছে। এটা তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই শুরু করে। তারা সব সময়ই কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। যে কারণে জনগণকে সব সময় প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
——————————————————————
মতামত
—————————————————————-
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময়ও আওয়ামী লীগ নির্বিচারে দেশের মানুষকে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগ দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে। আপাতত মনে হতে পারে, আওয়ামী লীগ তো এ দেশেরই রাজনৈতিক দল। কিন্তু জনসাধারণকে সব সময় প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে কেন ? সব সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায় কেন ?
এ দুই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারলেই আওয়ামী লীগের খুনি চরিত্রের হিসেব মেলানো যাবে। মূল বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক দলে হলেও মূলত ভারতপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। দলটি বরাবরই নিজ দেশের মানুষের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। এ কারণে বরাবরই দলটি জনসাধারণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ মূলত ভারতের নীতি–কৌশল সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ হিসাবে বলা যায়, আওয়ামী এই দেশের সাধারণ মানুষের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। পারা সম্ভবও নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল–আদর্শের ছাপ দেখা যায়।
কংগ্রেস যেমন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচিত ; আওয়ামী লীগও নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু এই দুটি দলই দুই দেশে ক্ষমতায় থাকাকালে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। দুই দলই ধর্মকে প্রয়োজনের সময় রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে। আবার দুই দলই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট নিজেদের বলে মনে করত।
————————————————————————————–
জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেশে আওয়ামী লীগ ও সামরিক বাহিনী একসঙ্গে থাকতে পারাও সম্ভব নয়। দেশের নিরাপত্তার প্রধান রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করলে হয় সেনাবাহিনী থাকবে, আর যদি জাতীয় স্বার্থকে খাটো করে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়, তবে আওয়ামী লীগ টিকে থাকবে। এই প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। মূলত এ কারণেই সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগে গ্রহণযোগ্যতা কম।
————————————————————————————–
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ ভারতের একধরনের সম্প্রসারিত অংশে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের রাজনীতির জন্য শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, এ ধরনের রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকা দেশের ভবিষ্যতের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ঝুঁকিপূর্ণ একটি দল।
সামরিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ভূরাজনীতি ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে ভারত। এরপর মিয়ানমারের অবস্থান।
ভবিষ্যতে সরাসরি যুদ্ধ হলে এ দুই দেশের সঙ্গেই হবে। এর বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর শঙ্কা কম, যদি না বিশ্বের বড় কোনো শক্তি বাংলাদেশ দখল না করে বা হামলা না করে। ভারত ও মিয়ানমার অতিক্রম করে এসে চীন বাংলাদেশে হামলা করবে না। অথবা যুক্তরাষ্ট্রও এসে দখল করবে না। ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ার মতো অবস্থা বাংলাদেশের হবে না বলেই মনে করা হয়।
তবে এ রকম কোনো দেশের হামলার বিষয়টি অবশ্যই আমাদের প্রতিরক্ষানীতি ও সামরিক কৌশলে থাকবে। কিন্তু সামরিক কৌশল মূলত নির্ধারিত হবে ভারত ও মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে। এই দুটি দেশই সরাসরি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সামরিক হুমকির কারণ হতে পারে।
ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই আমাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই খুব বেশি উষ্ণ ছিল না ; বরং সামরিক কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের সামরিক কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ও অবদান ছিল।
ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশেষ সখ্যর বিষয়টি তাঁরা ওই সময় থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছেন, যা তাঁদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনতার পরপরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যম গড়ে ওঠা সামরিক বাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ভারতের পরামর্শে সেনাবাহিনীকে দুর্বল ও অকার্যকর করতে রক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। সামরিক বাহিনী ওই সময় এটা মেনে নেয়নি, যা পরবর্তী বিভিন্ন কার্যকলাপে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেশে আওয়ামী লীগ ও সামরিক বাহিনী একসঙ্গে থাকতে পারাও সম্ভব নয়। দেশের নিরাপত্তার প্রধান রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করলে হয় সেনাবাহিনী থাকবে, আর যদি জাতীয় স্বার্থকে খাটো করে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়, তবে আওয়ামী লীগ টিকে থাকবে। এই প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। মূলত এ কারণেই সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগে গ্রহণযোগ্যতা কম।
অনেকেই বলতে পারেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের আমলকে সামরিক বাহিনী সমর্থন করেছে। আয়নাঘর সামরিক কর্মকর্তাদেরই তৈরি। এখানে বলে রাখা ভালো, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রতি সামরিক বাহিনীর একাংশের সমর্থন ছিল। সামরিক বাহিনীর গুটিকয় কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছেন, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
ভারতের ডিপ স্টেট আমাদের সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সম্ভবত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কাজ শুরু করে। যার ফলাফল আমরা গত ১৬ বছরে দেখেছি। কিন্তু পুরো সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ভারত নিতে পারেনি ; যে কারণে ৫ আগস্ট জনসাধারণ সফল হয়েছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে তাড়াতে। সামরিক বাহিনীর সমর্থনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
শান্তি মিশন নিয়ে জাতিসংঘের হুমকির পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর একাংশের অনিচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়ায়নি। তা না হলে হাসিনার শাসন আরও দীর্ঘায়িত হতো।
শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও তৎপরবর্তী ঘটনা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিতে হাসিনাকে সাময়িক সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের পরামর্শে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। ফলে শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী এগিয়ে আসেনি। তিনি পালাতে বাধ্য হন।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নিরাপত্তার কৌশল সাংঘর্ষিক। কারণ, আওয়ামী লীগ বরাবরই ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এটা স্বাধীনতার পরপরই ফারাক্কা চালু করতে দেয়া, ২৫ বছরের চুক্তি বা গত ১৫ বছরে ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। নদী ভরাট করেও ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ভারতের দিক থেকে বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা দরকার। এটাই হবে ভারতের কৌশল।
——————————————————————————————-
কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে এটা সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। একমাত্র ভারতের স্বার্থ ঠিক রাখতে আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে। পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে; যদিও নির্বিচার পাখি হত্যা করাও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্দয়ভাবে মানুষ হত্যা করেছে।
——————————————————————————————-
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অনুতাপ পরিলক্ষিত হয়নি; বরং তারা এখনো পলাতক অবস্থায় হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। ঠিক এ কারণেই আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতিতে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। ফিরে আসতে দেয়া উচিতও হবে না। যদি কখনো আওয়ামী লীগ ফিরতে পারে, তবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা আবারও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply