খাগড়াছড়ি : আলুটিলা ‘মাউন্টেন ব্রিজ’ এখন নান্দনিক নিসর্গেও শীর্ষে

  • আপডেট সময় শনিবার, মে ৭, ২০২২
  • 427 পাঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি
——————–

খাগড়াছড়ির আলুটিলা হয়ে ওঠেছে মনোরম এক পর্যটন বিলাসের অপূর্ব ঠিকানা। প্রবেশ পথের সুদৃশ্য তোরণ, দুই পাহাড়ের সংযোগ রেখা টেনে তৈরি করা হয়েছে রঙিন মাউন্টেন ব্রিজ, নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য ফুল-তৃণ-লতা আর পাতাবাহারের ‘কুঞ্জছায়া’, বিনোদনের জন্য ‘অ্যাম্ফি থিয়েটার এবং ‘সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার’ ও মানসম্মত রেস্টুরেন্ট।

জানা গেছে, পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের যৌথ অর্থায়নে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বিকশিত ‘আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র’ হার মানিয়েছে জেলা অন্যসব পর্যটন স্পটকে। সাজেক ফেরত বা সাজেকমুখী পর্যটকদের কাছে আলুটিলা এখন নান্দনিক নিসর্গেও শীর্ষে।

সাজেক’র ‘লুসাই ইকো ভিলেজ’র পরিচালক ইলোরা আজমেরী দোলা তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বলেন, খাগড়াছড়ি শহরকে পাখির চোখে এক পলক দেখার জন্য আলুটিলাই সঠিক স্থান। অন্ধকার অথবা জোছনা রাতে শহরের সৌন্দর্য দেখার অনুভূতি সত্যিই দার্জিলিং এর মতো।

কিন্তু আলুটিলায় আগে সেই আনন্দ উপভোগের পরিবেশ ছিল না। এখনকার আলুটিলা আর দুই বছর আগের আলুটিলা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না।

আরও জানা গেছে, আলুটিলা পর্যটন এলাকায় নির্মাণাধীন দুই কোটি টাকার চারতলা রেস্ট হাউস ‘খুমপুই’। যেটির নির্মাণ শেষ হলে পর্যটকদের আর রাত যাপনের জন্য শহরে ফেরার চিন্তা থাকবে না। প্রায় ৪২ লাখ টাকায় তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।

পাহাড়ের জাতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার জন্য অ্যাম্ফি থিয়েটার। যেখানে এক সাথে গ্যালারিতে পাঁচশ’ দর্শনার্থী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন। এর ফলে স্থানীয় শিল্পী-কলা কুশলীরাও লাভবান হবেন। একই সাথে সাংস্কৃতিক সুরক্ষার কাজটিও এগোবে সমান তালে।

জেলায় এই প্রথম নির্মিত এ্যাম্ফি থিয়েটার প্রসঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জিতেন চাকমা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেই পাহাড় ও নৃ-জাতির সৌকর্য্য-সংস্কৃতিকে পুঁজি করেই বিকশিত হয়েছে। সম্প্রতি নবরূপে সজ্জিত আলুটিলা যে কোন পর্যটককে দেশের ভেতরই সেই হৃদয়গ্রাহীতা এনে দেবে।

আলুটিলার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আলুটিলার দুই পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘মাউন্টেন ব্রিজ’টি ইতিমধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। জেলার বাইরের পর্যটকদের পাশাপাশি জেলা শহর এবং বিভিন্ন উপজেলার সব বয়সী নারী-পুরুষদের কাছেও ঝুলন্ত প্রকৃতির সেতুটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।

যদি বলি সবুজ পত্রপল্লবে গাঁথা ‘কুঞ্জছায়া’র কথা, যেন বলে শেষ না করতে পারার মতোই। নিজ চোখে দেখা মানুষ বোরহান উদ্দিন আহম্মেদ। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার তরুণ এই রাজনীতিক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সৃষ্টিকর্তার অপার সৌন্দর্যের উর্বর পাহাড় আলুটিলাকে নতুনরূপ দিয়েছে ‘কুঞ্জছায়া’। করোনার শিথিল পরিবেশে যে ক’বার আলুটিলা গিয়েছি মনে হয়েছে ‘কুঞ্জছায়া’র আলো-ছায়া আর মেঘ বৃষ্টির দারুণ এক লুকোচুরি।

চট্টগ্রামের সুখ্যাত শিল্পী মঈনুল আলম মনে করেন, সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে ধারণ করে ঋতুভিত্তিক গান-কবিতার আসর, উন্মুক্ত আর্ট ক্যাম্প, ঘুড়ি উড়ানো এবং ভোজন বিলাসের মতো উপভোগ্য আয়োজন করা গেলে এই আলুটিলাই একদিন খাগড়াছড়ি জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠবে।

আলুটিলা ঘিরে ‘মাউন্টেন ট্যুরিজম (পর্বত পর্যটন)’ সম্ভাবনার প্রসঙ্গে বলেন, শহর থেকে দূরে এমন নিরিবিলি পাহাড় বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি শহরে রয়েছে। আর যদি সে পাহাড়ের সীমানার ভেতরই রেস্ট হাউজ, ওয়াচ টাওয়ার, মাউন্টেন ব্রিজ, রেস্টুরেন্ট আর অ্যাম্ফি থিয়েটার থাকে; তা হলো তো আর কথাই নেই।

খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক এস অনন্ত ত্রিপুরা। একই সাথে গত একযুগ ধরে পরিচালনা করছেন জেলার সুপরিচিত বিলাসবহুল হোটেল ‘গাইরিং’। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আগে খাগড়াছড়িতে পর্যটকরা যদি রাত্রিযাপন করতেই হতো, তাহলে বিকেল-সন্ধ্যা বেলায় শুধু বাজারেই ঘুরপাক খেতেন। সময় কাটানোর মতো কোন নির্ভরযোগ্য জায়গা ছিল না। বর্তমান জেলা প্রশাসকের সময়কালে পাল্টে যাওয়া আলুটিলা’র কারণে এখন সাজেকমুখী পর্যটকরা অন্তত: এক বেলা বাড়তি সময় কাটাচ্ছেন খাগড়াছড়িতে। এটি নিঃসন্দেহে পর্যটন ব্যবসার জন্য সুখবর।

খাগড়াছড়ির পার্বত্য পিকআপ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কিশলয় তালুকদার জানান, করোনা’র বিধিনিষেধ শিথিল হবার খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেকগামী পর্যটকের আগমন বেড়েছে। তবে বেশিরভাগ পর্যটকই খাগড়াছড়িতে রাত্রিযাপন কিংবা বেড়াতে আগ্রহী হতেন না। কিন্তু গত ছয়মাস ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পর্যটকরা আলুটিলায় গিয়ে গুহা এবং রিছাং ঝর্না দেখার পর আরো কিছুটা সময় অবস্থান করছেন। এতে পরিবহন-আবাসন এবং রেস্টুরেন্ট খাতে একটি বাড়তি পাওয়া।

তিনি মনে করেন, আলুটিলার বহিরাঙ্গিক দৃশ্যায়নের পরিবর্তনই এর কারণ।

খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই পর্যটন কেন্দ্রটি জেলা প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এটি অনেকটা খাগড়াছড়ি সদর ও মাটিরাঙা উপজেলার সীমান্ত লাগোয়া।

এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হেমেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রটি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায়। আগে সূর্য না ডুবতেই অন্ধকারের ভয়ে পর্যটনগেট বন্ধ হয়ে যেতো। এখন আলো ঝলমল আলুটিলায় আমার ইউনিয়নের অনেক নারী-পুরুষ ক্ষুদ্র ব্যবসা করেই জীবিকা নির্বাহ করছে।

তিনি মনে করেন, আলুটিলা থেকে জেলা শহর পর্যন্ত সড়কবাতি নিশ্চিত করা গেলে আলুটিলায় স্থানীয় দর্শনার্থী আরো বাড়বে।

পুলিশ সুপার মো. আব্দুল আজিজ জানান, আলুটিলা যেহেতু শহর থেকে একটু দূরে তাই ওখানে একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এছাড়া আশ-পাশের এলাকায় কমিউনিটি পুলিশের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবাও নিশ্চিত করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির ডিসি প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আলুটিলার পর্যটন গুরুত্বকে ফুটিয়ে তুলতে একটি বিজ্ঞান সম্মত মাস্টারপ্ল্যান করে, সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় স্থাপত্যশৈলী, পাহাড় ও মৃত্তিকা সংরক্ষণের দিকেও সংবেদনশীলতা বজায় রাখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটির টাকার প্রকল্প শেষের পথে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!