থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কিছু কথা

  • আপডেট সময় শনিবার, মে ৭, ২০২২
  • 323 পাঠক

ডা. মাফরুহা আক্তার
—————-

জনস্বাস্থ্য প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা। এটি মূলত জিনগত ও জন্মগত একটি রক্তশূন্যতাজনিত রোগ।

আক্রান্ত রোগীদের সারা জীবন চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। যেমন বারবার রক্ত পরিসঞ্চালন করা, আয়রন কমানোর ওষুধ সেবন ইত্যাদি। সামষ্টিক চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। যেহেতু বংশগত রোগ তাই পিতা ও মাতা উভয়েই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তবে অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হতে পারে।

উল্লেখ্য, বাহকের নিজের তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে না। তাই বাহক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব থাকে। অথচ রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রফরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই নির্ণয় করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া কী?
এটি রক্তের হিমোগ্লোবিন সম্বন্ধীয় জিনগত একটি সমস্যা। অর্থাৎ বাবা-মা থেকে রোগটি সন্তানের দেহে আসে। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীদের হিমোগ্লোবিন কম উৎপাদন হয় অথবা ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। ফলে রোগীর রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

লক্ষণ কী কী : রক্তশূন্যতা প্রধান লক্ষণ। জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চার রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। কারও ক্ষেত্রে আরও পরে দেখা দিতে পারে। তীব্রতা অনুযায়ী রোগের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। দেহের লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে যায়। শিশুর আকার ও গড়নে ঘাটতি দেখা দেয়। রক্তশূন্যতার জন্য প্রায়ই রক্ত পরিসঞ্চালন লাগে।
২-৬ সপ্তাহ পরপর বা কারও কারও বার বার রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। তাছাড়াও নানা জটিলতা দেখা দেয়। যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে ও সঠিকভাবে রোগটি ধরতে না পারলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

আমাদের দেশে কি এই রোগ খুব বেশি?
থ্যালাসেমিয়া হাজার বছরের পুরনো একটি রোগ। সারা বিশ্বেই এই রোগ আছে। এটি সর্বাধিক বিস্তৃত একটি জেনেটিক রোগ। এর মধ্যে বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক সবচেয়ে বেশি। ফলে শুধু বিটা থ্যালাসেমিয়ার রোগীই জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার। সমগ্র বিশ্বের প্রায় সাত শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়ার বাহক।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ বাংলাদেশেও প্রচুর থ্যালাসেমিয়ার বাহক আছে। বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম থেকে জানা যায়, আমাদের দেশের ৭ থেকে ১১ শতাংশ লোক এই থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। অর্থাৎ ১৭ কোটি জনগণের মোট প্রায় দুই কোটি লোক থ্যালাসেমিয়ার বাহক।

এ ছাড়াও হিমোগ্লোবিন ‘ই’ নামক একটি ভ্যারিয়েন্ট হিমোগ্লোবিন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বেশি লক্ষ করা গেছে। বিশেষত সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলাতে এর সংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগ।

বাহক কারা?
মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম আছে। এর মধ্যে এগারো নম্বর ক্রোমোজমের একটি অংশ গ্লোবিন চেইন উৎপাদন করার জিন। এই জিনটি যদি ত্রুটিপূর্ণ বা মিউটেশন হয় তবে বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়। আর যদি এগারো নম্বর এর দুটি ক্রোমোজম আক্রান্ত হয় তবে তারা আক্রান্ত হয়।

বাহক অর্থাৎ এরা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। এরা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করে, তেমন শারীরিক কোনো সমস্যাই হয় না বা রক্তশূন্যতা তেমন হয় না। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় কে বাহক। রক্তের এই বিশেষ পরীক্ষার নাম হলো হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রফরেসিস।

বাহকের সমস্যা কোথায়?
নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সমস্যাই নেই। তবে একজন বাহক যদি অন্য কোনো বাহককে বিয়ে করে তবে অনাগত সন্তানের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পারিবারিক আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে এমন সমস্যা হতে পারে।

সেই ক্ষেত্রে অনাগত সন্তানের নিচের যেকোনো একটি হতে পারে
* ২৫% আশঙ্কা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
* ৫০% আশঙ্কা থ্যালাসেমিয়ার বাহক।
* ২৫% সম্ভাবনা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন।

আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো শিশুরা থ্যালাসেমিয়া মেজর হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। আর তা প্রতিরোধযোগ্য।

বাহক শনাক্তকরণ উপায়: প্রাথমিকভাবে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা যায় ও পরবর্তীতে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রফরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।

যাদের জন্য প্রযোজ্য :
পারিবারিক ইতিহাসে রক্ত সম্পর্কের কেউ থ্যালাসেমিয়ার রোগী বা বাহক হলে।
বিয়ের আগে যে কেউ পরীক্ষা করে নিতে পারে।
পিতা-মাতা উভয়েই যদি বাহক হন তবে গর্ভের সন্তানের রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। তবে উভয়েই যদি হিমোগ্লোবিন ই-এর বাহক হন তবে এই পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
রক্ত শূন্যতার কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের উপায়:
১. বাহক + বাহক বিয়ে বন্ধ করা। (যদিও বাস্তবজীবনে অনেকটা কঠিন বাস্তবায়ন করা)।
২. যদি বিয়ে হয়েই যায় তবে অনাগত সন্তান রোগাক্রান্ত কি না এই পরীক্ষা করা (anti natal screening) ও ব্যবস্থা নেওয়া (আরও কঠিন বাস্তবে)।
৩. সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা ও জনসচেতনতা তৈরি করা, যাতে সবাই নিজের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে জানতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। এটিই আমার মতে সহজ উপায়।

বাহক কাকে বিয়ে করবে?/ বা বাহককে কে বিয়ে করবে?
একজন বাহক যেহেতু স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন তাই তার কোনো সমস্যা নেই, শুধু স্বাভাবিক রক্তের একজনকে বিয়ে করবে। কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো বাহককে নয়। এখন সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমাদের দেশে কেউ যদি জানে একজন বাহক তবে তাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। মনে করে কী দরকার বাপু! ঝামেলা করার! অথচ একজন স্বাভাবিক জিনের মানুষের কোনো সমস্যাই হয় না বাহককে বিয়ে করলে। সেক্ষেত্রে সন্তানের রোগাক্রান্ত হওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই। এখানে আমাদের আরও উদার মানসিকতার হতে হবে।

স্কুলে স্ক্রিনিং করা ও সচেতনতা তৈরি :
বিভিন্ন ক্লাসের বইতে আজকাল স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়। যেহেতু থ্যালাসেমিয়া একটি জাতীয় সমস্যা, তাই এ বিষয়ের ওপর শিশু-কিশোরদের পাঠ্যক্রমের আওতায় এনে জানালে তারা সচেতন হবে। তাদের বাবা-মায়েরাও সচেতন হবেন। তাছাড়াও স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে স্ক্রিনিং প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নিতে পারে। সচেতনতা বাড়লে অবশ্যই প্রতিরোধ জোরালো হবে বলে আমার বিশ্বাস।

থ্যালাসেমিয়ার রোগীর চিকিৎসা কী?
১. নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন (এতে করে রক্তে অতিরিক্ত আয়রণ জমে যা ক্ষতিকর)।
২. রক্তের আয়রন কমানোর ওষুধ নেওয়া।
৩. নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। কারণ নানা জটিলতা তৈরি হয় এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া।
৪. প্লীহা সার্জারি (splenectomy) করে ফেলে দেওয়া। ক্ষেত্র বিশেষে এই চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে হয়।

একেবারে নির্মূল করার কোনো উপায় আছে কি?
আছে। অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন (allogeneic bone marrow transplantation) পদ্ধতির মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীর শরীর থেকে সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল করা যায়।
আপন ভাইবোন যদি সুস্থ/ক্যারিয়ার হয় আর তার সঙ্গে যদি ১০০% (একটি বিশেষ পরীক্ষা দ্বারা নির্ণয় করা যায়) ম্যাচ হয় তবে তার শরীরের স্টেম সেল নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ৯০% ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে রোগমুক্ত করা যায়।

আমাদের দেশে কি Marrow transplant হয়? খরচ কেমন?
আমাদের দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বাংলাদেশের চারটি হাসপাতাল কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জন্য যেমনটি দরকার তেমনটি এখনো শুরু হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে ব্যাপক আকারে শুরু হবে।
খরচ প্রায় ৩০ লাখের বেশি টাকা যদি বিদেশে করে। বাংলাদেশে শুরু হলে সরকারি হাসপাতালে এই খরচ আনুমানিক বারো লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে আশা করি।

সম্প্রতি ঢাকা সামরিক হাসপাতালে একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীর সফল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে।

শেষ কথা : যেই পরিবারে একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীর মাসে মাসে রক্ত দিতে হয় তারা জানে এর ভয়াবহতা কী পর্যায়ের। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানেন কতটা দুর্বিষহ জীবন এই রোগীদের। একটু খানি সচেতনতা পারে এই জটিলতা থেকে মুক্তি দিতে। তাই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উন্মুক্ত চিত্তে থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করা উচিত। শনাক্তকরণ পরীক্ষার পর বাহক নির্ণয় হলে তার উচিত পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করানো। একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক অন্য একজন বাহককে বিয়ে করবেন না। থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ হোক সামাজিক আন্দোলন।

লেখক: রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট
হেমাটোলজি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!