দিশারী ডেস্ক
————
দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে অপরিণত মৃত্যু বাড়ছে। দেশে যত মৃত্যু হয় তার ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে ৩০ থেকে ৭৯ বছরের ১২৮ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের। পুরো বিশ্বেই অকাল মৃত্যুর বড় কারণ উচ্চ রক্তচাপ।
এমন পরিস্থিতিতেই আজ ১৭ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’।
বিশ্বজুড়ে যেমন উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বাংলাদেশেও। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি পাঁচজনে একজন (২১ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। চিকিৎসকদের ভাষ্যে ‘নীরব ঘাতক’ এই উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি, স্ট্রোক এবং কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক এবং কিডনির ক্ষতি হয়। সরকার অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর (রিলেটিভ রিডাকশন) জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সব স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ এবং মৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। এর লাগাম টেনে ধরতে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা এক্ষেত্রে কার্যকর এবং ব্যয়-সাশ্রয়ী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা উদাসীনতা বা অসচেতনতা। যেমন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের অর্ধেকই জানেন না তারা এতে আক্রান্ত। আবার যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের অর্ধেকের বেশি জানেন না উচ্চ রক্তচাপ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ১০০ জনের মধ্যে ৭৭ জন ওষুধ খাচ্ছেন, কিন্তু তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নারীদের অর্ধেক (৫১ শতাংশ) এবং পুরুষের দুই-তৃতীয়াংশ (৬৭ শতাংশ) জানেন না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডির তথ্যমতে, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে (এনসিডি) লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও এই রোগের প্রকোপ লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে মৃত্যুর প্রথম ১৫টি শীর্ষ কারণের মধ্যে রয়েছে হার্ট অ্যাটাক, যা মোট মৃত্যুর ২১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে ব্রেন স্ট্রোক (১০ শতাংশ)। মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৬ শতাংশের জন্য দায়ী শ্বাসজনিত রোগ, ব্রেন স্ট্রোক ও হৃদরোগ। এ ছাড়া মোট মৃত্যুর ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, লিভার ক্যানসার, কিডনি রোগ। আর এ সবকিছুর মূলে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত কুমার বড়ুয়া জানান, ‘যারা স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আর অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।’
উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২০১৮ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এনসিডি কর্নার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং ফলোআপ’ কার্যক্রম চলছে। সারা দেশে এই এনসিডি কর্নারের সংখ্যা দুই শতে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান জানান, উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ সেভাবে কেউ খেয়াল করে না। হয়তো অন্য কারণে চিকিৎসকের কাছে এসে বা অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর বোঝা যায় তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।’
দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৩ কোটির মতো রোগী রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে এটা যে কোনো বয়সেই এখন হতে পারে। বিশেষ করে তরুণ বয়সের রোগী তো ঊর্ধ্বগতিতে বাড়ছে।’
তিনি জানান, দেশে যে প্রায় ৩ কোটি রোগী রয়েছেন তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই জানেন না তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। যারা জানেন তাদের মধ্যে আবার ৬৫ শতাংশ চিকিৎসা নেন না, আর যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ১০০ জনের মধ্যে ১৪ জনের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অর্থ্যাৎ ৮৬ জনের রক্তচাপই অনিয়ন্ত্রিত। আর যারা জানেন, তারাও ঠিকমতো চিকিৎসা নেন না, মাঝপথে থামিয়ে দিচ্ছেন।
মাঝপথে চিকিৎসা কেন থামিয়ে দিচ্ছেন রোগীরা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে মানুষের মনে ভুল ধারণা রয়েছে যে, একবার এর ওষুধ খাওয়া শুরু করলে সারা জীবন খেতে হয়। যার কারণে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে আসতে চান না। আবার আসার পর যখন ওষুধ দেয়া হয়, তখন সেটা তারা কন্টিনিউ করেন না। এখানে ওষুধের দাম এবং রুটিন মেনে খাওয়াটাও একটি বড় বিষয়।’
কেবল নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত নয়, অনেক উচ্চবিত্তরাও মাঝপথে ওষুধ থামিয়ে দেন। তখন ফের সেটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। বিশেষ করে গ্রামে যখন উপজেলা পর্যায় থেকে ওষুধ দেয়া হয়, এরপর তারা আর আসেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব, অনেক সময় ওষুধ না পাওয়া—এসব কারণে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর এসব কারণেই নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।’
অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’। এর প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রতিটি মানুষকে নিজের রক্তচাপ মাপতে হবে, ভালো মেশিন দিয়ে মাপতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
Leave a Reply