ফার্মেসিতে বাড়ছে মানহীন ওষুধ

  • আপডেট সময় রবিবার, মে ২১, ২০২৩
  • 145 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট

————-

দেশের বিপুলসংখ্যক ফার্মেসিতে মানহীন ওষুধ বাজারজাতের শঙ্কা আরও বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ফার্মেসি অনেক বেশি। আর কর্তৃপক্ষ ফার্মেসির সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে। কিন্তু তদারকি নেই। ফলে দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে মানহীন ওষুধ বাজারজাতের শঙ্কা।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সব শেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মিলেছে এ তথ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০-২১) বলা হয়, দেশে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৯টি নিবন্ধনধারী ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি রয়েছে। এরপর ওই বছরের জুন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে আরও ৪৬ হাজার ৮৭৯টি ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়া হয়। বর্তমানে দেশে মোট ফার্মেসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৪৮৬। এসব ফার্মেসিকে নির্ধারিত নিয়ম মেনেই নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা জেলায় ফার্মেসির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় ২৭ হাজার ৮০০ ফার্মেসি রয়েছে। আর সবচেয়ে কম পার্বত্য জেলা বান্দরবানে, ৪৫০টি। বিভাগভিত্তিক হিসেবে ঢাকার ১৩টি জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ৫৬ হাজার ৯২৭, ময়মনসিংহের চার জেলায় ১০ হাজার ৯০১, সিলেটের চার জেলায় ১০ হাজার ৮৯৬, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৩৬ হাজার ৬৯৫, বরিশালের ছয় জেলায় ১৪ হাজার ৩৮৬, রংপুরের আট জেলায় ১৮ হাজার ৩২৭, খুলনার ১০ জেলায় ২৫ হাজার ৯৯৭ ও রাজশাহীর আট জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ২৮ হাজার ৩৯৯টি। ওষুধ খাত এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ফার্মেসিতে ওষুধ সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে রয়েছে বহুবিধ নিয়মকানুন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়মিতভাবে এসব দেখভাল করার দায়িত্ব। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই না করেই দেশে হাজার হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৬ হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। মাত্র পাঁচ মাসে এতসংখ্যক ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়ায় ওষুধের মান ও গুণাগুণ বজায় রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তাতে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন ওষুধ বাজারজাতের আশঙ্কা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ওষুধের মান শুধু কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন করা না হলেও ওষুধের গুণাগুণ নষ্ট হয়। কখনো কখনো তা জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ফার্মেসি অনেক বেশি। প্রতিনিয়তই কর্তৃপক্ষ ফার্মেসির সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ওষুধের মতো জনগুরুত্বপূর্ণবিষয়কে অবহেলা করা হচ্ছে। এসব ফার্মেসিকে ১৯৪৬ সালের ওষুধ আইন (দ্য বেঙ্গল ড্রাগ রুলস ১৯৪৬) অনুযায়ী আবেদনের বিপরীতে নিবন্ধন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এর জন্য নির্দিষ্ট কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিয়ম আনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর নিবন্ধন নবায়নও করতে হয় ফার্মেসিগুলোকে।

মূলত মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ দুই শ্রেণিতে বর্তমানে নিবন্ধন দিচ্ছে অধিদফতর। এর বাইরেও রয়েছে পাইকারি ফার্মেসি, হোমিওপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি, হারবাল খুচরা ফার্মেসি, ইউনানি খুচরা ফার্মেসি, আয়ুর্বেদিক খুচরা ফার্মেসি ও অ্যালোপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ২২০টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৪৬টি ইউনানি, ১৫৮টি আয়ুর্বেদিক, ৫১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩৩টি হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়।

তাছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে এসব প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২ সালেও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ রফতানি হয়েছে। কিন্তু দেশে দুই-তৃতীয়াংশ ওষুধের দোকানে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। ওষুধ সংবেদনশীল পণ্য। তাপমাত্রার কিছুটা হেরফের হলেই কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। দেশে যে ধরনের ওষুধ রয়েছে তার প্রায় ৯০ শতাংশই ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।

ওষুধভেদে সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ভিন্নতা রয়েছে। ওষুধ ঠান্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়। অধিকাংশ ফার্মেসির বিক্রেতারা ওষুধ সংরক্ষণের যথাযথ নির্দেশনাও জানেন না। ওষুধভেদে সংরক্ষণের জন্য সঠিক তাপমাত্রা নিয়ে তাদের ধারণা নেই। অথচ মান বিবেচনা করেই ওষুধের দোকানের নিবন্ধন দেয়া প্রয়োজন। যাতে কেউ আবেদন করলেই নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। এসব বিবেচনা করে মডেল ফার্মেসি, মডেল মেডিসিন শপ শ্রেণিতে নিবন্ধন দেয়া শুরু হয়েছিল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ বিতরণ হয়। সে জন্যই এতে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ফার্মেসিগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাসে এত সংখ্যক ফার্মেসি নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।

সূত্র আরও জানায়, এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে দুই লাখের বেশি ফার্মেসি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। একটা বাজারে ফার্মেসির সংখ্যা অনেক থাকে। গ্রাম বা শহর সব এলাকায় ফার্মেসির সংখ্যা খুবই বেশি। পৃথিবীব্যাপী ওষুধের ফার্মেসির ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম রয়েছে তা এ দেশে দেখা যায় না। সব দেশেই একজন দক্ষ ফার্মাসিস্টের হাতে এসব কাজ হয়। ফার্মেসি আইনকানুন ও নিয়ম মেনে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দিলে বাকি দায়দায়িত্ব ফার্মেসির। সব ওষুধ একই তাপমাত্রায় রাখা যায় না। এসব বিষয় এ দেশের ফার্মেসিতে মানা হয় না।

তাছাড়া প্রতি বছরই দেশে ফার্মেসির সংখ্যা বাড়াচ্ছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে সে তুলনায় এসব ফার্মেসিকে পরির্দশন ও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনছে না সংস্থাটি। তাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বিক্রয়, মান নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়। এতে দিন দিন স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে সাড়ে ৩৫ হাজার ফার্মেসির নিবন্ধন নবায়ন করা হলেও ওই অর্থবছরে পরিদর্শন করা হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার। তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) পরির্দশন করা হয় সাড়ে ৩৬ হাজার ফার্মেসি। ওষুধের দোকানগুলো সঠিক নিয়ম মানছে কিনা তা তদারকির জন্যই মূলত পরিদর্শন করা হয়।

এদিকে ফার্মেসি নিবন্ধন দেয়া প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন জানান, চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে বিনা লাইসেন্সে কোনো ওষুধের দোকান না থাকে। যাদের লাইসেন্স নেই তাদের সময় দেয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় মামলা দেয়া হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সিলগালা করে দোকান বন্ধও করা হয়েছে। এসবের কারণে সম্প্রতি আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিক পেলে তখন নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। কতসংখ্যক ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়া হবে তা বিবেচ্য বিষয় নয়, দেখা হয় যাকে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে তার সবকিছু ঠিক আছে কিনা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!