কুমিল্লা : গুলি করে সাংবাদিককে হত্যা, নেপথ্যে শীর্ষ মাদক কারবারিরা

  • আপডেট সময় শনিবার, এপ্রিল ১৬, ২০২২
  • 356 পাঠক

কুমিল্লা প্রতিনিধি 

——————

মাদকবিরোধী অবস্থানের কারণেই কুমিল্লার বুড়িচংয়ে সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে সীমান্ত এলাকায় কৌশলে ডেকে নিয়ে যান তাঁরই দুই বন্ধু। এরপর জেলার শীর্ষ মাদক কারবারি মো. রাজু ও তাঁর সহযোগীরা মহিউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নিহতের স্বজন ও সহকর্মীরাও এমনটা দাবি করেছেন।মহিউদ্দিনের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে পরিবার। শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদসভায় মহিউদ্দিনের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। কুমিল্লা ফটো সাংবাদিক ফোরাম ও বুড়িচং প্রেসক্লাবের যৌথ আয়োজনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় মহিউদ্দিনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ঘটনার তিন দিন পার হলেও হত্যা মামলার প্রধান আসামি ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচংয়ের শীর্ষ মাদক কারবারি মো. রাজু গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।

মহিউদ্দিন হত্যার ঘটনায় পুলিশ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বুড়িচং উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হচ্ছেন বুড়িচংয়ের ময়নামতি ইউনিয়নের বিনুন্দিয়ারচর এলাকার মো. ফরহাদ মৃধা ওরফে মনির হোসেন, কংশনগর এলাকার মো. পলাশ মিয়া, শঙ্কুচাইল এলাকার নুরু মিয়া ও সুজন মিয়া। তাঁদের মধ্যে পলাশ ও মনির এজাহারভুক্ত আসামি। গতকাল শুক্রবার দুপুরে তাঁদের কুমিল্লার আদালতে পাঠানো হয়।

গত বুধবার রাত ১০টার দিকে বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের হায়দ্রাবাদনগর এলাকায় মহিউদ্দিনকে (২৮) গুলি করে হত্যা করা হয়। মহিউদ্দিন পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের মোশারফ হোসেন সরকারের ছেলে। তবে তাঁরা কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। মহিউদ্দিন আগে আনন্দ টেলিভিশনের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। এ ছাড়া ‘দৈনিক কুমিল্লার ডাক’ নামে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে স্টাফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলেন।

মহিউদ্দিন হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মা নাজমা বেগম বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে মাদক কারবারি মো. রাজুকে। রাজু জেলার আদর্শ সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাদেক মিয়ার ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অস্ত্র, মাদক, চোরাচালানের মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ঘটনার পর থেকেই মহিউদ্দিনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

জানা গেছে, মহিউদ্দিন দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন। ছোট ভাই হৃদয় সরকার সৌদি আরবে থাকেন। একমাত্র বোন শারমিন আক্তার কুমিল্লা নগরীতে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ পুলিশে ৩৪ বছর চাকরি শেষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান। তিনি পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ছিলেন।

মহিউদ্দিনের বাবা মোশাররফ হোসেন গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি সব সময় ছেলেকে বলেছি জীবনে যত বাধাই আসুক, ন্যায়ের পথে থাকতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার হতে হবে। আমার ছেলে সব সময় এ কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলায় মাদক কারবারি ও চোরাকারবারিরা আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমি খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাদের কারণে আমাকে বাবা হয়ে ছেলের লাশ কাঁধে নিতে হয়েছে। ’

মা নাজমা বেগম বলেন, ‘মাদক কারবারি ও চোরাকারবারিরা আমার ছেলেছে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই। ’

মহিউদ্দিনের বন্ধু স্থানীয় সাংবাদিক মাহফুজ বাবু বলেন, ‘মহিউদ্দিন সব সময় মাদক ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছেন। এসব কারণে মাদক কারবারিরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। ’

বুড়িচং প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক বাবু বলেন, শীর্ষ মাদক কারবারি রাজুর নেতৃত্বে মহিউদ্দিনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাজুকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। কুমিল্লার সীমান্ত এলাকার মাদক কারবারিরা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে এখনই জোরালো অভিযান শুরু করা না হলে সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। ’

নিহতের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহিউদ্দিন পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে তথ্য দিয়ে মাদকদ্রব্য জব্দে সহায়তা করতেন। মাদক কারবার নিয়ে তিনি ফেসবুকে লেখালেখিসহ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন করায় মাদক কারবারিরা মহিউদ্দিনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এ কারণেই মাদক কারাবারিরা মহিউদ্দিনকে হত্যা করেছে।

বুড়িচং থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, মাদককারবারি রাজুর সঙ্গে যোগসাজশ করে মহিউদ্দিনকে সীমান্ত এলাকায় কৌশলে ডেকে নিয়ে যান তাঁরই দুই বন্ধু মনির ও পলাশ। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাদককারবারিরা তাঁকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। নিহতের পরিবারও বলছে, গ্রেপ্তার মনির ও পলাশ ছিলেন মহিউদ্দিন পূর্বপরিচিত। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

ওসি জানান, মনির ও পলাশ ঘটনার সময় মহিউদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন। এই দুজন মহিউদ্দিনকে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। নিজেদের নির্দোষ বোঝাতে হত্যাকাণ্ড শেষে মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যান তাঁরা। নুরু মিয়া ও সুজন মিয়া ঘটনাস্থলে হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। এই চারজনকে আদালতে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।

এদিকে ঘটনার পর গ্রেপ্তার হওয়া পলাশ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বলেন, ‘মাদকের একটি বড় চালান দেশে ঢুকবে—এমন খবর পেয়ে মহিউদ্দিনসহ আমরা হায়দ্রাবাদনগর গ্রামে যাই। গ্রামে পৌঁছার এক মিনিটের মধ্যেই অন্তত ৩০ জনের একটি দল আমাদের ঘেরাও করে। এ সময় মাদক কারবারি মো. রাজু কোমর থেকে পিস্তল বের করে মহিউদ্দিনকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। সেখানে গিয়েছিলাম আমার নিজের মোটরবাইকে করে। তারা বাইকটি ভাঙচুর করেছে। এই ফাঁকে আমি আর মনির কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসি। ’

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!