ডেস্ক, দৈনিক দিশারী
——————–
চোখের অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ হচ্ছে রেটিনা। চোখের অন্যান্য অংশের তুলনায় রেটিনা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
রেটিনার যত্ন-আত্তি নিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আফজাল মাহফুজউল্লাহ
রেটিনা কী ?
———-
রেটিনা হলো চোখের অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ বা পর্দা, যা দ্বারা দৃষ্টির প্রতিচ্ছবি মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। স্বভাবতই রেটিনা একটি স্বচ্ছ জালকসদৃশ, যা অনেক ক্ষুদ্র রক্তনালি দ্বারা বেষ্টিত থাকে আর অত্যধিক রক্তজালকের সমন্বয়ের কারণেই যেকোনো শারীরিক পরিবর্তনে চোখের অন্যান্য অংশের তুলনায় চোখের রেটিনা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
একটি জিনিসের পরিপূর্ণ যত্নের জন্য আসলে প্রয়োজন ওই অঙ্গের গঠন ও পরিচর্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে জানা। তাহলেই ওই নির্দিষ্ট অঙ্গের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
আর এই সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই কিছু সুনির্দিষ্ট রেটিনা রোগ, যেগুলোর ব্যাপারে একটি সতর্কতা অবলম্বন করলে চোখের রেটিনা সুরক্ষিত রাখা যায়। রেটিনার বিশেষ রোগগুলো হলো—
১. ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
২. উচ্চ রক্তচাপজনিত রেটিনার রক্তক্ষরণ
৩. অপরিণত নবজাতক শিশুর অন্ধত্ব
৪. বয়সজনিত রেটিনার ক্ষয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির উপসর্গগুলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হলো রেটিনা অর্থাৎ চোখের ভেতরের পর্দাসদৃশ অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, যার মাধ্যমে আলো বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয়ে মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। এই সংবেদনশীল পর্দা বা রেটিনা অনেক রক্তনালি দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় থাকে। সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো রেটিনায় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে এই রক্তনালিগুলো বিভিন্নভাবে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস যদি অনিয়ন্ত্রিত থাকে। রক্তনালিতে ‘পেরিসাইট’ নামের একটি অংশ থাকে, যা ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে রক্তনালির পেরিসাইট ভেঙে যায় এবং রক্তনালি থেকে রক্ত ও রক্তরস বের হয়ে যায়। এই রক্তরস বের হয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করে, যা ‘রেটিনাল হেমোরেজ’ নামে পরিচিত। এই রক্তক্ষরণের আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে।
প্রথম পর্যায়ে এই রক্তক্ষরণ রেটিনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে এই রক্তক্ষরণ রেটিনার বাইরে চলে আসে, যা ‘প্রিরেটিনাল হেমোরেজ’ নামে পরিচিত এবং পরবর্তী ধাপে তা রেটিনার সম্মুখভাগে যে জেলি/ভিট্রিয়াস অংশে প্রবাহিত হয় এবং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এই পর্যায়টি ভিট্রিয়াস ‘হেমোরেজ বা ইন্ট্রাজেল হেমোরেজ’ নামে পরিচিত। এ ধাপ যদি অগ্রসর হতেই থাকে, তাহলে যা ঘটে সেটি হলো দৈহিক কিছু প্রটেক্টিভ সিস্টেম আছে, যা ইন্ট্রাজেল রক্তক্ষরণ প্রতিহত করতে ভিট্রিয়াস জেলিতে কন্ট্রাকশন করার ফলে তা রক্ত, রক্তনালি, ভঙ্গুর রেটিনা ও জেলি একত্র হয়ে ট্র্যাকশন ফোর্স তৈরি করে, যা ভঙ্গুর রেটিনাকে সম্পূর্ণ ছিঁড়ে ফেলে। এই স্টেজটি অ্যাডভান্সড স্টেজ হিসেবে ধরা হয়। উপরোক্ত বিষয়গুলোকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায়—
ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়বেটিক রেটিনোপ্যাথি
♦ রক্তনালি সামান্য স্ফীত হয়ে যায়, যা মাইক্রোঅ্যানিউরিজম নামে পরিচিত।
♦ রক্তক্ষরণ হয়
♦ রেটিনাল এক্সিউডেট জমা হওয়া
এ পর্যায়কে প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি তেমন ব্যাহত হয় না। তবে এ পর্যায়ে পৌঁছলে আপনাকে অবশ্যই বছরে একবার একজন রেটিনা বিশেষজ্ঞ দ্বারা চোখের রেটিনা পরীক্ষা করা জরুরি। কারণ এই স্তর থেকে সামনের দিকে রেটিনোপ্যাথি অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে, যা ভবিষ্যতে আপনার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে।
প্রিএলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
—————————————
রেটিনার বড় বড় রক্তনালি আরো ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকে। এর ফলে রেটিনার বিভিন্ন অংশে পুষ্টি ও অক্সিজেন ঘাটতি হতে থাকে। ফলে ভিইজিএফ লেভেল বাড়তে থাকে এবং নতুন রক্তনালি তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার মতো ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ও ঝুঁকির কারণে আরো বেশি নিবিড় পর্যায়ে থাকতে হবে অর্থাৎ চোখের ডায়লেটেড ফান্ডস্কোপি বা রেটিনা পরীক্ষা করাতে হবে।
এলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
————————————-
এ পর্যায়ে আগের স্টেজে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভিইজিএফের আধিক্য যত্রতত্র নতুন ভঙ্গুর রক্তনালি তৈরি করে চোখের স্বাভাবিক পুষ্টি ও অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য, কিন্তু তা হিতে বিপরীত হিসেবে দেখা দেয়। এই ভঙ্গুর রক্তনালি রক্তপ্রবাহ করতে গিয়ে ফেটে যায়, যা রেটিনার রক্তক্ষরণ ঘটায়।
অ্যাডভান্সড ডায়াবেটিক আই ডিজিজ
————————————-
এটি সর্বশেষ ধাপ এবং এ পর্যায়ে ক্ষরিত রক্ত চোখের জেলি বা ভিট্রিয়াস, ভঙ্গুর রক্তনালি একত্র হয়ে ট্র্যাকশনাল রেটিনাল ডিটাচমেন্ট তৈরি করে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি আমরা সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য চোখের রেটিনাকে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি—
♦ সেন্ট্রাল রেটিনা-স্যাকুলা অংশ/রক্তজালকবিহীন অংশ।
♦ রক্তজালক সমন্বয় রেটিনার পর্দা।
সেন্ট্রাল রেটিনা/ম্যাকুলা অংশ
——————————
এ অংশে মূলত পানি জমে, যা ভঙ্গুর রক্তনালি থেকে বের হয়। এটি ম্যাকুলোপ্যাথি/ ডায়াবেটিক ম্যাকুলোপ্যাথি নামে পরিচিত। ম্যাকুলা হলো রেটিনার সবচেয়ে সংবেদনশীল ক্ষুদ্র অংশ, যা ব্যবহার করে আমরা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখতে পারি।
চিকিৎসাব্যবস্থাগুলো জেনে নিই
——————————-
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসা আমরা কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি—
১. নিবিড় পর্যবেক্ষণ
২. চোখের লেজার চিকিৎসা
৩. ইন্ট্রাভিট্রিয়াল চোখের ইনজেকশন
৪. চোখের রেটিনার মাইক্রোসার্জারি
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে যখন ব্যাকগ্রাউন্ড স্টেজে/প্রিএলিফারেটিভ স্টেজে থাকবে, সে ক্ষেত্রে শুধু নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকলেই চলবে। কোনো ধরনের ইন্টারভেনশনের প্রয়োজন নেই। শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, প্রেসার নিয়ন্ত্রণ, রক্তের চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখলেই চলবে।
এলিফারেটিভ স্টেজে চোখের লেজার চিকিৎসা অবশ্যই করাতে হবে। লেজার চিকিৎসা সঠিক সময়ের মধ্যে না করালে চোখে রক্তক্ষরণ শুরু হবে, যা অ্যাডভান্সড স্টেজে চলে গেলে রেটিনা ছিঁড়ে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অ্যাডভান্সড ডায়াবেটিক আই ডিজিজ বা রেটিনা ছিঁড়ে গেলে তাতে ইনজেকশন/লেজার কার্যকর হয় না। সে ক্ষেত্রে রেটিনাল মাইক্রোসার্জারি/ পিপিভি সার্জারি করে সিলিকন অয়েল ইনজেক্ট করার প্রয়োজন পড়ে।
চোখের ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইনজেকশনের কাজ কী?
সেন্ট্রাল রেটিনা বা রক্তজালকবিহীন অংশে
যে পানির আধিক্য দেখা দেয়, তা দূর করার জন্য চোখে ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইনজেকশন দেয়া হয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি কী কী
♦ দীর্ঘ সময় ধরে ডায়াবেটিসে ভোগা
♦ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
♦ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ
♦ গর্ভবতী অবস্থায় ডায়াবেটিস
♦ নিয়মবহির্ভূত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস
♦ ধূমপান।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি থেকে পরিত্রাণের উপায়
———————————————
♦ ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকে নিয়মিত প্রতিবছর একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ/রেটিনা বিশেষজ্ঞ দ্বারা চোখের রেটিনা পরীক্ষা করা।
♦ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
♦ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা
♦ রক্তের চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা
♦ স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার গ্রহণ
♦ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
♦ নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম
♦ নিয়মিত ওষুধ সেবন
♦ দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা থেকে দূরে থাকা
♦ ধূমপায়ী হয়ে থাকলে তা বর্জন করা
♦ দৃষ্টিশক্তির ব্যাপারে সামান্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে পেশাদার ও যুগোপযোগী পরামর্শ গ্রহণ ও মেনে চলা।
বয়সজনিত রেটিনার ক্ষয়
————————
বয়স বাড়ার সঙ্গে আমাদের শরীরের সব কিছুই দুর্বল হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে চোখের ওপর, যা ‘এএমডি’ নামে পরিচিত। ‘এএমডি’ হলো ম্যাকুলার অবনতি বা ভাঙন। বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের উপসর্গগুলো হলো কেন্দ্রীয় দৃষ্টি হারানো, যদিও নির্দিষ্ট কারণ অজানা ‘এএমডি’ বার্ধক্যের অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। ‘এএমডি’ দুই ধরনের হয়—
শুষ্ক ফর্ম এএমডি
——————–
এএমডি আছে এমন ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের শুষ্করূপ, যাকে বলা হয় ‘ড্রাই এএমডি’। শুকনা এএমডি বিকাশ করতে অনেক বছর সময় নেয়। তবে পুষ্টিকর খাদ্য ও কিছু ভিটামিনের অগ্রগতি ধীর করে থাকে। ভিটামিনগুলো হলো—লুটেইন, ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’।
ভেজা ফর্ম এএমডি
—————-
এটি অত্যন্ত গুরুতর এএমডির ভেজা আকারে অস্বাভাবিক রক্তনালি রেটিনার নিচে একটি স্তরে বৃদ্ধি পায় ও রক্তক্ষরণ ঘটায়। পরে এটি দৃষ্টিকেন্দ্রে বিকৃতি ঘটায়।
এটির চিকিৎসাব্যবস্থা হিসেবে চোখের ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইনজেকশন প্রতি মাসে একটি করে দিতে হয় প্রয়োজন সাপেক্ষে।
Leave a Reply