দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার

  • আপডেট সময় শনিবার, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৩
  • 251 পাঠক

——————————————————————————————————————–

সড়ক দুর্ঘটনায় বাড়ছে পঙ্গুত্ব

———————————————————————————————————————

দিশারী ডেস্ক। ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্য মতে হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

গত বছর যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক প্রতিবেদনে জানায়, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এর মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সি শিশু ১২ হাজারের বেশি। এই হিসেবে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়।

বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে সামনে চলে এসেছে। সড়ককে নিরাপদ করতে হলে বিভিন্ন মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা দরকার। ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা আনাটা আগে জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৬ সালে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় ও পঙ্গত্ব বরণ করে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ। সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধ করতে হলে শক্তিশালী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোড সেফটি অ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের প্রোজেক্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান বলেন, বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ (এটা মূলত পরিবহন সংক্রান্ত আইন) ও বিধিমালায় নিরাপদ সড়কের বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অনুপস্থিত থাকায়, আমাদের উচিত একটি নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা। যেখানে সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুর সব বিষয় উপস্থিত থাকবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট-২০১৮ সালের তথ্য অনুয়ায়ী, সুইডেনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি লাখে মৃত্যু ২.৮ জন, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি লাখে মৃত্যু ১৫.৩। তারা জাতিসংঘ ঘোষিত সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে রোডক্রাশে মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। এই সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ বাস্তবায়নে পাঁচটি স্তম্ভকে ( নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ মোটরযান, সড়ক ব্যবহারকারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ, দুর্ঘটনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং চালকের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশের নিশ্চয়তা ) গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ এমন যেখানে সড়ক ব্যবহারকারী কেউ ভুল করলেও সিস্টেম তাকে রক্ষা করবে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে সড়ককে নিরাপদ করতে হবে। এজন্য জাতিসংঘ নির্ধারিত নিরাপত্তা কৌশল অনুসরণ করে শক্তিশালী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রয়োজন—ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও বেপরোয়া গতির নিয়ন্ত্রণ। চালকদের অদক্ষতা ও শাররিক-মানসিক অসুস্থতা এবং চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল সড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

এছাড়া তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা এবং দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির বিষয়গুলোকেও দায়ী করেছেন তারা।

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দুই পা হারিয়েছেন তরুণ অটোরিকশা চালক হেলাল আহমেদ। তিনি বলেন, তখন আমার বয়স অনুমানিক সাত-আট বছর, ট্রাকে চড়ে শ্রমিকরা আখ কাটতে যাচ্ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমি চড়ে বসি ট্রাকে আখ খাওয়ার জন্য। হঠাত্ ট্রাক থেকে পড়ে আমার দুই পা কাটা পড়ে। বাপ-মা দুজনেই অন্য জায়গায় বিয়ে করে চলে গেছে। আমি ছন্নছাড়া ঘুরে বেড়াতাম, ছোটবেলায় অন্যের দোকানে কাজ করতাম। এখন অটোরিকশা চালাই। এই দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। এখন ঠিকমতো রোজগার করতে পারি না। কেউ কাজে নিতে চায় না। একজন পঙ্গু মানুষের সারা জীবন অভাবে কাটে।

রাতের বেলায় দুই বন্ধু মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে মুখমুখি রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ে যায় রায়হান (২৪)। এতে থেঁতলে যায় ডান হতের তিনটা আঙ্গুল। সেখানে ইনফেকশন হলে গ্রামের চিকিত্সক পাঠায় ঢাকায় জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর)। সেখানে এসেও শেষ রক্ষা হয়নি রায়হানের। ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে না আসায় তার হাতের তালুর অর্ধেক অংশ কেটে ফেলা হয়। তরুণ রায়হানের জীবনে নেমে আসে পঙ্গুত্ব।

কেবল হেলাল আর রায়হানই নন, প্রতিদিন এমন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সঙ্গে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে পঙ্গুত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা। পরিবারের একজন ব্যক্তি পঙ্গু হলে তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় নানা ধরনের অবহেলা আর অসহায়ত্ব।

বিজ্ঞজনেরা বলছেন, সড়ককে নিরাপদ করতে হলে জাতিসংঘ প্রণীত গাইডলাইন বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, নিরাপদ যানবাহন নিশ্চিত করা, ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং চালকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!