——————————————————————————–
৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মীর মানসিক অবস্থা খারাপ
——————————————————————————–
দিশারী ডেস্ক। ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।
দেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী মানসিক নির্যাতনের শিকার। প্রায় ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মীর কর্মক্ষেত্রে চাপের কারণে মানসিক অবস্থা খারাপ থাকে, সামাজিকীকরণে হীনম্মন্যতায় ভোগেন ৯২ শতাংশ গৃহকর্মী, উদ্বেগ ও হতাশায় ভোগেন ৬৮ শতাংশ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন ৬০ শতাংশ গৃহকর্মী।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নারী গৃহশ্রমিকদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু গবেষণায় ওঠে আসে এমন চিত্র।
গৃহকর্মীদের কর্ম ও জীবনধারণ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, গৃহকর্মীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে বেশির ভাগেরই নির্ধারিত কোনো থাকার রুম নেই। রাতে থাকতে হয় বসার ঘরে। অনেক বাসায় মেহমানের আনাগোনা লেগেই থাকে। রাতে বসার ঘরে উন্মুক্ত জায়গায় ঘুমানোর সময় গোপনীয়তা রক্ষা হয় না। খুব ভোরে ওঠতে হয়, ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। গৃহকর্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। কাজের সময় পান থেকে চুন খসলে শুনতে হয় বিভিন্ন কটু কথা। তা ছাড়া বাসার পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকেও হয়রানির শিকার হতে হয় নারী গৃহকর্মীদের।
বিশেষজ্ঞদের এমন বিশ্লেষণের সত্যতা মিলে ঢাকায় কর্মরত এক গৃহকর্মীর। তিনি বলেন, এক সময় খুব চঞ্চল ছিলাম আমি। অনেক কথা বলতাম। এখন ঠিকমতো কথা বলতে পারি না। বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে। এখানে একটু ভুল হলেই বকা দেয়, অনেক সময় মারে।’ তার চেহারাতেও স্পস্ট ফুটে ওঠেছে- আত্মবিশ্বাসের অভাব ও বিষণ্নতার ছাপ। নিজেকে তিনি সবসময় গুটিয়ে রাখেন।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ। গতবছর অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ। তাদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ গৃহকর্মী হলো নারী। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার ঊর্ধ্বগামী খরচ, পেশার সহজলভ্যতা না থাকা, বিয়েবিচ্ছেদের কারণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের নারীরা গৃহকর্মীর কাজ বেছে নেন। এ পেশায় নিরাপত্তার অভাব, অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, নিম্ন মজুরি, শাররিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হেনস্তা, চাকরির অনিশ্চয়তাসহ নানাবিধ কারণে দেশের অধিকাংশ গৃহকর্মী কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এমনটাই দাবি করেছেন গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
এ ছাড়াও বিলসর গবেষণায় আরও ওঠে এসেছে ৯১ শতাংশ গৃহকর্মীর জেন্ডার সহিংসতার সাহায্য চাওয়ার বিষয়ে হেল্পলাইন নম্বর সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ৪২ শতাংশ আবাসিক গৃহকর্মী বসার ঘর কিংবা রান্নাঘরের মতো খোলা জায়গায় মেঝেতে ঘুমান। ৭৫ শতাংশ খণ্ডকালীন গৃহকর্মী বস্তিতে থাকেন।
জরিপ অনুযায়ী, গৃহকর্মীদের গড় মাসিক আয় ৫ হাজার ৩১১ টাকা, যেখানে তাদের মাসিক গড় খরচ ১০ হাজার ৮০১ টাকা। এ ছাড়া গবেষণায় অংশগ্রহণ করা ২৩ শতাংশ গৃহকর্মীর গত বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৯ টাকা। ৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী বলেছেন যে তাদের বর্তমান মজুরি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। ২৬ শতাংশ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বা বিলম্বের কারণে মজুরি কর্তনের শিকার হয়েছেন। আবাসিক গৃহকর্মীরা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। ৮৭ শতাংশ অনাবাসিক বা খণ্ডকালীন গৃহকর্মী কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ বিষয়ে ৯৯ শতাংশ গৃহকর্মীর এবং ৬৬ শতাংশ নিয়োগকর্তার কোনো ধারণা নেই।
গবেষণায় আরও ওঠে এসেছে বাসা-বাড়িতে কাজ করার সময় ১৭ শতাংশ নারী গৃহকর্মী ভাগাভাগি টয়লেট এবং গোসলের ব্যবস্থার কারণে নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং গোপনীয়তা হারানোর ভয়ে থাকেন। ২৬ শতাংশ নারী-গৃহকর্মী বাসার উন্মুক্ত স্থানে বসবাসের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বা নিরাপত্তা বা মর্যাদা নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন। মানসিক নির্যাতনের শিকার হন প্রায় ৬৭ শতাংশ, মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন ৬১ শতাংশ, শাররিক নির্যাতনের শিকার হন ২১ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৪ শতাংশ নারী-গৃহকর্মী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৬ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের ১৪ জন মারা যান। আবার চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ জন নির্যাতনের শিকার হন, যেখানে মারা যান ১০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, গৃহশ্রমিকরা অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সব দিক দিয়েই দুর্বল অবস্থানে থাকে। ফলে তাদের নির্যাতনে জড়িতদের সাজা হয় না বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজে বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি বহমান। এ কারণে সাধারণ মানুষ বা দুর্বল মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। যদিও-বা কোনো কোনো বিষয়ে মামলা হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থের দাপট, পেশির দাপট এবং রাজনৈতিক দাপটের কাছে পরাস্ত হতে হয় দুর্বলদের।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, গৃহকর্মীরা বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজের অংশ। আমাদের সমাজ যেহেতু পুরুষশাসিত, তাই পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সব জায়গায় এই পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা হয়। এর প্রভাব পড়ে গৃহকর্মীদের ওপর। অনেক সময় গৃহকর্তারা তাদের মানুষ ভাবেন না, তাই তাদের জন্য কোনো মানবিক মূল্যবোধ কাজ করে না।
তিনি বলেন, আমার মতে, দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন গৃহকর্মীই কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এ ছাড়া আমাদের দেশে নির্যাতনের শিকার হওয়া গৃহকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। এর বড় কারণ আমাদের দেশের আইনি কাঠামো তাদের অনুকূলে নেই। দেশে তাদের জন্য যে আইন আছে, তাতে সুবিচারের চেয়ে আইনি ঝামেলাই বেশি।
তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি, এসব বন্ধে আমাদের দেশের মানুষদের ভেতর প্রথমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তারপর একটা শক্ত আইন ও তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আর গৃহকর্মীদের কাজ পাওয়া থেকে বেতন পাওয়া সবকিছু একটি সিস্টেমের ভেতর নিয়ে আসতে হবে।
Leave a Reply