বাস্তবে রুহ আফজায় কিছুই নেই !

  • আপডেট সময় শনিবার, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
  • 287 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

৩৬ ধরনের টাটকা ফলের সুস্বাদু রস, মূল্যবান ঔষধি উদ্ভিদ ও তাজা ফুলের নির্যাস দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যকর হালাল পানীয় রুহ আফজা। এটি খেলে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। প্রাণভরে এই অমৃত সুধা পান করলে পূরণ হয় শরীরের পানির ঘাটতি।

মুখরোচক এমন তথ্যসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে পবিত্র রমজান মাসে বিক্রির শীর্ষে থাকে ‘ রুহ আফজা ’ নামের শরবত। যুগ যুগ ধরে এটি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ।

তবে পণ্যের লেবেল এবং বিজ্ঞাপনে সেসব উপাদানের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে রুহ আফজায় এখন আর এসবের কিছুই নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগে বাজার থেকে সংগৃহীত রুহ আফজা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। পণ্যের মিথ্যে প্রচারণার বিষয়টি স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছেন হামদর্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া।

আবার বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি না করতে হামদর্দের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তাকে ঘুষের প্রস্তাবও দেয়া হয়। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এবং খাদ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।

জানা যায়, শত বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে পরিচিত রুহ আফজা। ১৯০৬ সালে ইউনানি চিকিৎসক হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ পুরোনো দিল্লিতে তার চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ১৯০৭ সালে নিজস্ব উদ্ভাবনে বাজারে আনেন রুহ আফজা। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি মানুষের আস্থা অর্জন করে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তার বড় ছেলে ভারতে থেকে গেলেও ছোট ছেলে পাকিস্তান চলে যান। করাচিতে স্বতন্ত্র হামদর্দ (ওয়াকফ) ল্যাবরেটরিজ চালু করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানেও এর শাখা স্থাপিত হয়। স্বাধীনতার পর হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়।

বর্তমানে এটি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। হামদর্দের অনেক পণ্যের মধ্যে রুহ আফজা ভোক্তাদের চাহিদার শীর্ষে। বিশেষ করে রোজার মাসে এই শরবতের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক মো. কামরুল হাসান সম্প্রতি বাজার থেকে রুহ আফজা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করান। ফলাফলে রুহ আফজা বিক্রির প্রচারণায় ব্যবহৃত নানা তথ্যের সঙ্গে গরমিল প্রকৃত উপাদানের গরমিল পাওয়া যায়। পণ্যের প্রচারে স্বাস্থ্যকর ফলের শরবতসহ প্রাকৃতিক নানা উপাদানের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর কোনোটাই নেই।

প্রতারণার এমন প্রমাণ পেয়ে ২০১৮ সালে মামলা করেন সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শক। মামলার আসামি হামদর্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে লিখিত দেন। জরিমানা হিসেবে হামদর্দ চার লাখ টাকাও পরিশোধ করে। যদিও এরপর হামদর্দের পক্ষ থেকে আপিল করা হয় এবং আদালত জরিমানার টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দেয়।

সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়টি জানার পর এর বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেন। এর পরই সেই আপিল ঠেকাতে ওঠেপড়ে লেগেছে হামদর্দ কর্তৃপক্ষ। এমনকি কোম্পানিটির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছেন।

একটি ভিডিওতে দেখা যায় হামদর্দের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আলী আহমদ সিটি করপোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক মো. কামরুল হাসানকে আপিলের প্রক্রিয়ার আর না এগোতে বারবার অনুরোধ করছেন। এ জন্য অফিসিয়িল অনুমোদনের ভিত্তিতে টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন।

ভিডিওতে আলী আহমদকে বলতে শোনা যায়, আমি হামদর্দ অফিস থেকে এসেছি। আপনি যদি আপিল না করেন তবে আপনাকে অনার করা হবে। আমরা যেই রায়টা পেয়েছি সেটাই থাকুক।

ভিডিওতে হামদর্দের ওই কর্মকর্তাকে আরও বলতে শোনা যায়, আমরা রুহ আফজায় যা আছে, তার চেয়ে অতিরিক্ত বলি।

এ বিষয়ে কামরুল হাসান বলেন, মিথ্যে তথ্য দিয়ে রুহ আফজা বিক্রি করছে হামদর্দ। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আমি যাতে আপিল না করি, সেজন্য হামদর্দের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার ঘুষের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে ঘুষের প্রস্তাব দেয়ার সময় ভিডিও করে রেখেছি।

তিনি বলেন, শুধু ঘুষ অফার নয়, হামদর্দ শুরু থেকেই অনৈতিক কাজ করছে। একটি আদালতে নিজেদের দোষ স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেয়ার পর আরেক আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করাটাই অনৈতিক।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, কেউ স্বেচ্ছায় আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে মুচলেকা দিলে, সেক্ষেত্রে আপিল করার কোনো সুযোগ থাকে না। কেউ যদি তথ্য গোপন করে আদালতের কাছে আপিল করেন, তাহলে তা আইনের ব্যতয়।

এদিকে হামদর্দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। এতে রুহ আফজা নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি উল্লেখ করে ঘুষের প্রস্তাবকারী আলী আহমদ ও হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

একইভাবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়াকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

পরে হামদর্দের জনসংযোগ কর্মকর্তা আমিরুল মোমেনীন মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। আপনার কাছে যা শুনলাম, তা আমার কাছে একেবারেই নতুন। তবে আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি জানাতে পারব।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!