কোচিং, গাইডবই বাণিজ্য বন্ধ হবে কবে ?

  • আপডেট সময় শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
  • 114 পাঠক

দিশারী ডেস্ক।৩ মে,২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

বিদ্যালয়ের বেতন, প্রাইভেট টিউটর-কোচিং ও সহায়ক বই বাবদ শিক্ষা ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই তিন খাতে প্রায় ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়েছে। তবে প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিক পর্যায়ে খরচের হার তুলনামূলক বেশি। অতিরিক্ত এই খরচ অভিভাবকদের সীমিত আয়ের ওপর চাপ তৈরি করছে ক্রমাগতভাবে। শিক্ষা ব্যয় কমাতে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম।

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে অভিভাবকদের পক্ষে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সব জিনিসের দাম যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী তাদের আয় বাড়েনি। ফলে সংসারই তো চলছে না, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ দেবে কীভাবে ? তাই আমাদের দাবি হলো- শিক্ষা উপকরণ যেন সরকার সরবরাহ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক ফি বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ করে বিদ্যালয়েই সব পড়ানো হোক। আমরা অভিভাবকরা জিম্মি হয়ে গেছি সরকার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ-২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় আগের বছরের (২০২২) তুলনায় প্রাথমিক স্তরে বার্ষিক ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় স্তরেই প্রধানত ব্যয় হয়েছে প্রাইভেট টিউটরের বেতন ও গাইডবই বা নোটবই বাবদ।

২০২২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিশুর শিক্ষার জন্য বার্ষিক পারিবারিক গড় ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ৮৮২ টাকা এবং মাধ্যমিকে ছিল ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা, যা গ্রাম ও শহরভেদে ভিন্নতা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পরিসংখ্যানের তুলনায় শিক্ষা ব্যয় আরও বেড়েছে। বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর কোচিংয়ে বিষয়প্রতি খরচও একই হারে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সহায়ক বইয়ে। এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া শিক্ষা উপকরণের এককালীন ইউনিফর্ম আর স্কুলব্যাগ এসবেরও দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।

নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রের অভিভাবক বলেন, ছেলের স্কুলের মাসিক বেতন গত বছর ছিল ৫০০ টাকা। এখন সেটি ৮০০ টাকা। আর প্রাইভেট শিক্ষককে একটি সাবজেক্টের জন্যও এখন ১০০০ টাকা দিতে হচ্ছে। আমি দলিল লেখকের কাজ করি। কিন্তু আয় তো আমাদের আর বাড়েনি। সবকিছুর দাম বেড়েছে।

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের মা ফাতেমা জানালেন, ২০২৩ সালে ছেলের জন্য মাসিক শিক্ষা খরচ হতো প্রায় ৪ হাজার টাকা। স্কুলের বেতন ৫০০ টাকা, পরীক্ষার ফি ৮০০ টাকা (প্রতি মাসে ২টি পরীক্ষা), টিউটরের বেতন ১ হাজার ২০০ টাকা এবং শিক্ষা উপকরণের জন্য ব্যয় হতো ১ হাজার ২০০ টাকা। সেখানে ২০২৪ সালে স্কুলের বেতন ৮০০ টাকা, পরীক্ষার ফি ১ হাজার টাকা, টিউটর ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং শিক্ষা উপকরণ ১ হাজার ৮০০ টাকা হয়েছে। হিসাব করে দেখা যায়, মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

অস্বাভাবিক শিক্ষা উপকরণের দাম 

স্টেশনারি দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর শিক্ষা উপকরণের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তবে গত বছরে তিন থেকে চার দফায় দাম বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে ১২৪ পৃষ্ঠার খাতা বসুন্ধরা ৫৫ টাকা, জেএমএল ৬০ টাকা ও ফ্রেশ ৫৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। গত ডিসেম্বরের আগে এগুলোর দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। জানতে চাইলে এক বই দোকানের মালিক বলেন, দাম যা বাড়ার আগে বেড়েছে। এ বছর সেভাবে দাম বাড়েনি।

তবে অনেক পণ্যের দাম কোম্পানির পক্ষ থেকে বাড়ানো হলেও আগের দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দোকানদারদের। কেননা ক্রেতারা বেশি দাম হলেই আর কিনছেন না। আরেকটি লাইব্রেরির মালিক শামিম বলেন, আগে রাবার কেনা পড়ত ৩ টাকা। বিক্রি করতাম ৫ টাকায়। এখন কেনা পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা, বিক্রি করতে হচ্ছে আগের দামে। ৮৪ পৃষ্ঠার খাতার দামেও এই অবস্থা। আগে ২২ টাকা কিনতাম, বিক্রি করতাম ৩০ টাকায়। এখন কেনা ২৭ টাকায়, বিক্রি ৩০ টাকায়।

অন্যদিকে নোটবই বা সহায়ক বইয়ের দাম গত বছরের তুলনায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত বছর তৃতীয় শ্রেণির এক সেট সহায়ক বইয়ের দাম ছিল ৪৫০ টাকা, যা এখন ৫০০ টাকা। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির সহায়ক বইয়ের দাম ছিল ১ হাজার টাকা, যা এখন ১ হাজার ৯০০ টাকা। আর অষ্টম শ্রেণির সহায়ক বইয়ের দাম ছিল ১ হাজার ৩৪০ টাকা, যার বর্তমান মূল্য ২ হাজার টাকা। এ বিষয়ে নীলক্ষেতের ‘বই জগৎ’-এর মালিক মিজানুর রহমান বলেন, দুটি শ্রেণি ছাড়া বাকি সব ক্লাসের নোট বইয়ের দাম বেড়ে ডাবল হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেছেন, ২০২২ সালে ইউনেসকোর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার ব্যয়ের ৭১ শতাংশ বহন করে পরিবার। এই শিক্ষার খরচটা দিন দিন বাড়ছে, কমছে না। সরকার একটা সিদ্ধান্ত মোটামুটি নীতিগতভাবে নিয়েছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালুর চিন্তা করা হচ্ছে। যেটা এখন মূলধারার প্রাথমিকে আছে। সেটা মাধ্যমিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। সরকার যদি অবৈতনিক করে দিতে পারে।

আরেকটা হলো মাধ্যমিকে উপবৃত্তিটা সর্বজনীন না। উপবৃত্তিটাও বাড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার চেয়ে আর্থিক অনুদানটা সরাসরি পরিবারের কাছে দেওয়া উচিত। উপবৃত্তির ক্ষেত্রে আমরা যে জিনিসটি দেখেছি, মায়ের মোবাইলে গেলে এটা যথাযথভাবে ব্যয় হয়। আগে স্কুলে দেয়া হতো, এটা আমরা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলাম এর পুরোটা দেয়া হতো না। তারপর থেকে এটা সরাসরি মায়ের মোবাইলে যাচ্ছে।

তবে উপবৃত্তির পরিমাণটা লজ্জাজনকভাবে কম। অনেক দিন ধরে মুদ্রাস্ফীতি সব জায়গায় সমন্বয় করা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষা খাতে করা হয়নি। শিক্ষকদের বেতন-ভাতায় যেমন করা হয়নি, তেমন উপবৃত্তির খাতেও করা হয়নি। এটা করাটা জরুরি। এটা করলে শিক্ষা ব্যয় কমে আসত। এসডিজির নীতিমালায় আছে- দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে শিক্ষা, বাংলাদেশ সেখানে স্বাক্ষর করেছে। অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করা গেলে শিক্ষা ব্যয় কিছুটা কমবে। একই সঙ্গে উপবৃত্তি বাড়ানো এবং মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করতে হবে।

শিক্ষা ব্যয় বাড়ার পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষানীতি অল্প সময়ের মধ্যে বারবার পরিবর্তন করা হয়। এ রকম পরিবর্তনটার মধ্যে কোনো সদিচ্ছার পরিচয় পাওয়া যায় না। যে পরিবর্তনগুলো করা হয়, দুই দশক ধরে বলা হচ্ছে সিলেবাস কারিকুলাম খুবই ভালো। কিন্তু এটা পড়ানোর জন্য যে যোগ্য লোক দরকার তা দেশে নেই। শিক্ষকদের ট্রেনিং করে যোগ্য করে তুলতে হবে। একটার পর একটা নতুন শিক্ষানীতি আসছে, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হচ্ছে, আমার অভিজ্ঞতা একটা খারাপ থেকে নতুন আরেকটা খারাপের দিকে যায়। এটা কমানোর দৃষ্টিভঙ্গি নেই। একটা ভুল রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সদিচ্ছার অভাব হলো এখানে বড় কারণ। নানা কারণে সরকার তার পেছনে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্র নানা প্যাঁচের মধ্যে ফেলে রাখে। কিন্তু জনগণের সরকার হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে অবস্থাটা কাটানো সম্ভব হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এখানে স্কুলের বেতনটা ঠিক আছে। এটা তো সবাইকেই দিতে হবে। কারণ নিয়ম হচ্ছে স্কুলের পড়া তো স্কুলেই করাতে হবে। বাকি কোচিং ফি যেটা, সেটা তো সবার জন্য বাধ্যতামূলক না। কিন্তু বিভিন্ন দেশে, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আমি দেখেছি ছেলেমেয়েরা কোচিংয়ে যায় না। এটা আমাদের দেশেই বেশি দেখি। হয়তো আরও অনুন্নত দেশে থাকতে পারে। এই কোচিং বাণিজ্য সরকারের হাতে না। আমার মনে হয় এগুলো একেবারে নিষিদ্ধ করা উচিত। এমনিতেই তো আমাদের দেশে পাঁচ রকমের শিক্ষাব্যবস্থা আছে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অনেক কম থাকে। অথচ ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার যে নিয়ম করে গিয়েছিলেন সেখানে ছিল জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের বেতন এখনো অনেক নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।’

তিনি বলেন, কোচিং বাণিজ্য, গাইডবই বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। এগুলোর জন্যই ব্যয় বেড়ে যায় অভিভাবকদের। অবশ্য কোচিং চালু রাখার পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করে। সরকারের উচিত শিক্ষায় কোনোভাবেই কোনো সিন্ডিকেট যাতে না থাকে সেই ব্যবস্থা নেয়া। অন্যদিকে প্রাইভেট টিউটরের পেছনে যেটা খরচ হয়, সেটাও তো বাড়তি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যদি ভালো বেতন পেতেন, তবে হয়তো শিক্ষার মান আরও ভালো হতো। স্কুলেই শিক্ষকরা হয়তো আরও ভালো করে পড়াতে পারতেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!