দিশারী ডেস্ক। ২ ডিসেম্বর, ২০২৪
আওয়ামী লীগ আমলে দেশ থেকে পাচার ২৮ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে ( প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা ) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
রোববার অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। ওই প্রতিবেদনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের টাকা পাচারের আনুমানিক এই চিত্র তুলে ধরা হয়।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে টাকা পাচারের হিসেব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
——————————————————————
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে অর্থ পাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টাকা পাচারের বিষয়টিকে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ‘টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর টিউমার চুষে নেয়।
——————————————————————
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।
এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাস আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই প্রতিবেদন তুলে দেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাজ হলো চুরির বর্ণনা দেয়া, চোর ধরা নয় বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, মোট ১২ জন নামজাদা অর্থনীতিবিদ নিয়ে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিটির মাধ্যমে এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, দুর্নীতির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। কমিটির কাজ চোর ধরা না, চুরির প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা।
তিনি বলেন, কমিটির প্রতিটি সদস্য বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই শ্বেতপত্র তৈরি করা হয়েছে। এমনকি যতটি সভা হয়েছে, সেখানে একটি পয়সা সিটিং অ্যালাউন্স নেয়া হয়নি।
———————————————————————
তবে বিদেশি পরামর্শক এনে এই শ্বেতপত্র করা হলে ন্যূনতম ২৫ কোটি টাকা খরচ হতো বলে জানান তিনি। কমিটি এটি দেশের জন্য নিঃস্বার্থ অবদান হিসেবে করেছে, যা দেশের স্বার্থে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
——————————————————————-
রিপোর্টটিকে সাবধানতার কারণে এখনো খসড়া হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিছু পরিসংখ্যান পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। আগামী ১ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে এটি ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা হবে। এই রিপোর্টের গ্রন্থস্বত্ব স্বয়ং বাংলাদেশ সরকার। এটিকে সরকার নিজস্ব দলিল হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান বলেন, প্রথাগত গবেষণা পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। দেশি-বিদেশিদের সাথে আলোচনা করে এই প্রতিবেদনের নানা দিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে আমরা নিজেরা ১৮ বার সভা করেছি।
নীতিনির্ধারকদের সাথে ২২ বার সভা করেছি। আমাদের প্রথম সভা ছিল ছাত্রদের সঙ্গে। তাদের সর্বোচ্চ জোর ছিল মানসম্মত শিক্ষার ওপরে। শ্বেতপত্রের পুরো প্রক্রিয়া না বুঝলে এই দলিলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। জনমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে এটি প্রস্তুত হয়েছে।
——————————————————————
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ডক্টর জাহিদ হোসেন বলেন, বিগত সময়ে দেশের অর্থনীতিবিদরা মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়ার যে সম্ভাবনার কথা বলতো। আমরা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এখন বলছি, বাংলাদেশ মধ্য আয়ে ফাঁদে পড়ে গেছে। তবে বিগত সরকার যেহেতু বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির তথ্য-উপাত্তকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেখিয়েছিল। তাই এই ফাঁদের মধ্যে পড়ে যাওয়াটা আমরা এতদিন বুঝতে পারেনি।
——————————————————————
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিগত সরকারের আমলে শুরুর দিকে বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হয়েছিল তা ছিল শ্যাডো ইকোনমি। বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে সে অর্থনীতি কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শেষের দিকে যে দুর্নীতি হয়েছে তার অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে।
Leave a Reply