রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে মিথ্যের পরিণতি দুঃসহ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫
  • ৯ পাঠক

শাব্বির আহমদ ।। ২৮ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।

মানব ইতিহাসে মিথ্যে সর্বদাই অন্ধকারের প্রতীক। মিথ্যে শুধু যে ব্যক্তিগত নৈতিকতা ধ্বংস করে তা-ই নয়, এটি পরিবারে অবিশ্বাস, সমাজে বিভেদ ও ভ্রান্তির জন্ম দেয়। কিন্তু মিথ্যেরও স্তর আছে। কেউ নিজের স্বার্থে মিথ্যে বলে, কেউ বলে অন্যকে হাসানোর জন্য।

সবই অপরাধ। অথচ ইসলামে এমন এক মিথ্যে আছে, যা শুধু অপরাধ নয় ; বরং আখিরাতেও অনিবার্য ধ্বংসের কারণ। আর তা হলো মহানবী (সা.)-এর নাম ব্যবহার করে মিথ্যে বাণী ছড়ানো।

যিনি আল্লাহর রাসুল, যিনি ওহির বাহক, যিনি সমগ্র মানবতার মুক্তিদাতা, তাঁর নামে মনগড়া কথা প্রচার করা আল্লাহর বাণী বিকৃত করার শামিল।

রাসুল (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন— যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে আমার নামে মিথ্যে আরোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন প্রস্তুত করে নেয়। (বুখারি, হাদিস : ১০৭; মুসলিম, হাদিস : ৩)

একজন মানুষ যদি জীবনে হাজারো গুনাহও করে, তবু তাওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যে রটনা এত ভয়াবহ যে এর ফলে সরাসরি জাহান্নামে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

কোরআনের দৃষ্টিতে মিথ্যেরোপের অপরাধ

মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপকারীর চেয়ে বড় জালিম আর কে ? (সুরা : আনআম, আয়াত : ২১)

আল্লাহর রাসুল (সা.) আল্লাহর ওহি ছাড়া কিছুই বলেননি।

তাঁর প্রতিটি বাণী মহান আল্লাহর অনুমোদিত। তাই তাঁর নামে মিথ্যে বলার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নামে মিথ্যা চাপিয়ে দেওয়া। এটি শুধু দুনিয়ার সমাজে বিভ্রান্তি আনে না, বরং আখিরাতে চিরস্থায়ী গজব ডেকে আনে।

সমাজে প্রচলিত হাদিসের নামে বানানো কথা

আমাদের সমাজে এমন বহু কথা প্রচলিত আছে, যেগুলো শুনলে মানুষের আবেগ জাগ্রত হয় ; মনে হয় এগুলো হাদিস। অথচ প্রকৃতপক্ষে এগুলো মহানবী (সা.)-এর কথা নয়, বরং পরবর্তীকালে মানুষ বানিয়েছে।

এসব ভুয়া উক্তি কখনো রাজনীতির প্রয়োজনে, কখনো আবেগ জাগানোর জন্য, আবার কখনো ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে তৈরি হয়েছে।

হাদিসের নামে সমাজে বহুল প্রচলিত কিছু উক্তি—

১. ‘ দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো ’ বক্তব্যটি সুন্দর শোনায়। তাই মানুষ সহজে বিশ্বাসও করে। কিন্তু এটি কোনো হাদিস নয়। এর বিকল্প সহিহ হাদিস হচ্ছে—‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)

৩. ‘ দেশপ্রেম ঈমানের অংশ। ’ এই উক্তি প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সমাবেশে শোনা যায়। অথচ এটি বানানো কথা। ইসলাম দেশপ্রেমকে অস্বীকার করে না, তবে রাসুল (সা.) কখনো এভাবে বলেননি ; বরং মক্কার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় নগরী। যদি তোমার লোকেরা আমাকে বের না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৫)

৩. ‘ শবেবরাতে ৩৬০ রহমত নাজিল হয়। ’ জনপ্রিয় হলেও এটি ভুয়া ও বানানো কথা। এর বিকল্প সহিহ হাদিস হচ্ছে—‘ আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া তাঁর সৃষ্টির সবাইকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০)

আবার কিছু ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্রও পরিলিক্ষিত হয়ে। যেমন—‘ দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার, কাফিরের জন্য জান্নাত।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৫৬)

অনেকে এটিকে জাল মনে করেন, কিন্তু এটি মুসলিমে বর্ণিত একটি সহিহ হাদিস। (মুসলিম, হাদিস : ২৯৫৬)

এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, আমরা কত সহজেই মহানবী (সা.)-এর নামে কথা চালাচ্ছি, অথচ অনুরূপ আসল সত্য হয়তো পাশেই পড়ে আছে। একটু যাচাই-বাচাই করলেই এসব ভুল কথাগুলোর পরিবর্তে সঠিক হাদিসটি প্রচার করা যেত।

হাদিসের নামে বানানো কথা প্রচারে সমকালীন বাস্তবতা

আজকের সমাজে মহানবী (সা.)-এর নামে মিথ্যে হাদিস কত সহজে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে—

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বানানো হাদিস প্রচার : অনেক সময় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে দেখা যায়—‘ যে ব্যক্তি অমুক দিনে অমুক দোয়া পড়বে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।’ অথচ এমন কোনো কথা হাদিসশাস্ত্রে নেই। এগুলো সাধারণ মানুষ দ্রুত শেয়ার করে দেয়, ভেবে নেয়—এটা আসলেই নবীজির বাণী।

২. রাজনৈতিক বক্তৃতায় ব্যবহার : কিছু রাজনৈতিক নেতা বা বক্তা জনসমর্থন আদায়ের জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে নবীজির নামে কথিত ‘ হাদিস ’ বলেন। যেমন ‘ যে অমুক নেতাকে ভালোবাসবে, সে জান্নাতি ’—এমন দাবি করা হয়, অথচ ইসলামে এমন কথার কোনো অস্তিত্ব নেই।

৩. ব্যাবসায়িক প্রচারণায় মিথ্যা ব্যবহার : কোনো কোনো ব্যবসায়ী তাদের পণ্যের প্রচারে বলে—‘ নবীজি বলেছেন, এই ধরনের বস্তু ব্যবহার করলে রোগমুক্তি হবে।’ অথচ হাদিসে তা নেই, শুধু বিক্রয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে নবীজির নাম ব্যবহার করা হয়।

৪. ইউটিউব ও অনলাইন ভিডিওতে বানানো কথা : বর্তমানে কিছু বক্তা দর্শক বাড়ানোর জন্য শিরোনামে আকর্ষণীয় দাবি করেন, যেমন—‘ নবীজির এমন একটি বাণী, যা শুনলেই আপনি ধনী হবেন। ’ অথচ মূলত কোনো গ্রন্থে এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কোটি মানুষ এসব ভিডিও দেখে প্রতারিত হচ্ছে।

হাদিসের নামে বানানো কথা প্রচারের ভয়াবহ পরিণতি

ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুল (সা.)-এর নামে মিথ্যা বানানো নিজের জন্য জাহান্নামের ঠিকানা প্রস্তুত করার নামান্তর। সেই সঙ্গে এসব বানানো কথা মানুষকে ভুল পথে চালিত করে। একসময় সমাজ কুসংস্কার ও বিদআতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আল্লাহর বাণী বিকৃত করায় এমন লোকেরা আল্লাহর গজব ও লানতের যোগ্য হয়।

শিক্ষা ও সতর্কতা

এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে মহানবী (সা.)-এর নামে মিথ্যে কথা প্রচার শুধু অতীতের সমস্যা নয়, বরং আজকের যুগে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে আমাদের উচিত কোনো বাণীকে হাদিস হিসেবে শেয়ার করার আগে নির্ভরযোগ্য সূত্র যাচাই করা। শিশু-কিশোরদের শেখানো যে সব লেখা বা বলা কথাই হাদিস নয়। মসজিদ-মাদরাসা ও মিডিয়ার মাধ্যমে হাদিসের নামে বানানো কথা শনাক্তকরণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার বিকল্প নেই। কেননা রাসুল (সা.)-এর নামে মিথ্যা বলা ইসলামের মূলকেই বিকৃত করে ফেলে।

আমাদের দায়িত্ব হলো কোরআন ও হাদিসের প্রকৃত অনুসরণ ও সঠিক কথা প্রচার করা।

লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল ফিল হাদিস, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!