প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান।। ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির প্রতিষ্ঠার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন “ দ্রুতগতিতে জাতীয় ঐক্য আরও সুসংগঠিত করা ও জাতীয় কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে হলে নতুন ও ব্রড-বেজ্ড জাতীয় দল গঠন করাই উত্তম। ”(বিএনপি সময়- অসময়, মহিউদ্দিন আহমদ)
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামকরণটি করেছিলেন জিয়াউর রহমান নিজেই। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে এবং পূর্বঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচিকে ভিত্তি ধরে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রশাসনে চরম ব্যর্থতা, অপশাসন, মানুষের মানসপটে নতুন কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চাহিদা প্রবল করে তোলে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার যা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করে, চারটি মাত্র পত্রিকার সার্কুলেশন জারি রেখে, অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে চরমভাবে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছিল— জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ৪টি পত্রিকা থেকে ৪৪৪টি হয়েছে, ১টি রাজনৈতিক দল থেকে ৬২টি দল হয়েছে, গণতন্ত্রের পথে পুনর্জাগরিত হয়েছে বাংলাদেশ।
বিএনপি বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী, সুশিক্ষিত এবং সমাজের পরিচিত ব্যক্তিদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে যারা বিএনপির গঠনতন্ত্র লেখার কাজেও জড়িত ছিলেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, মওদুদ আহমদ, আব্দুল মোমেন খান, আবুল হাসনাত, ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম।
——————————————————————————————————————–
দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং গণমানুষের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার জন্য ১৯দফা কর্মসূচি জনগণের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই কর্মসূচিতে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার কথা যেমন বলা হয়েছে, পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, দেশকে নিরক্ষরতা থেকে মুক্ত করা, প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা এবং সর্বোপরি নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
——————————————————————————————————————–
বিএনপির খাল খনন কর্মসূচি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল যা বর্তমান বাংলাদেশেও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। জিয়াউর রহমান গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন, মানুষের সাথে নিজে হাত মেলাতেন, যা গণমানুষের মাঝে বিএনপির ভিত্তি শক্ত করে তোলে। গ্রামের মানুষের কাছে দেশের প্রেসিডেন্ট যাচ্ছেন, তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন, নিজের হাতে কোদাল দিয়ে খাল খনন করছেন, রাস্তার ধারে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন এই ধরনের জনবান্ধব কাজগুলো মানুষকে উদ্বেলিত করে।
বিএনপির কর্মীদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য জিয়াউর রহমান নিজেই ক্লাস নিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- সুশিক্ষিত কর্মীই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তিনি বলেছেন, সার্বিক জাতীয়তাবাদ—জনগোষ্ঠী, স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাংলা ভাষা, ধর্ম, ভৌগোলিক এলাকা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এই সবকিছুর সম্মিলন। মূলত জিয়াউর রহমানের সুষম উন্নয়ম ভাবনা, সুচিন্তিত স্বিদ্ধান্ত এবং দলে মেধাবী মানুষদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি জনপ্রিয়তার চরম শিখরে উঠেছিল।
রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে জিয়াউর রহমানের একটি দার্শনিক বয়ান ছিল। “ রাজনীতি ছাড়া অর্থনীতি হয় না। অর্থনীতি রাজনীতি ছাড়া করা যায় না। অর্থনীতি ছাড়া, রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া, প্ল্যান ছাড়া রাজনীতি পৃথকভাবে ইন আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন অবস্থায়) থেকে যাবে। রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে সামাজিক মুক্তি আসতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক, এ তিনটি একই সঙ্গে কাজ করে একই পেটের ভেতরে। সেভাবে আমরা এগিয়ে চলছি। ” (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৪৮)।
——————————————————————————————————————–
জিয়াউর রহমান বিএনপিকে একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সম্বন্ধে মওদুদ আহমদ বলেন— “ ১. প্রশাসন থেকে সামরিক বাহিনীকে দূরে রাখা। ২. রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় সংসদের মধ্যে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে জিয়া নিজেকে একজন মধ্যপন্থী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ” (বিএনপি সময়- অসময়, মহিউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১৬৫)।
——————————————————————————————————————–
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমান বিএনপিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করে। ওআইসি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরব বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের সাথে বন্ধুত্বময় সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু ভারতের আধিপত্যবাদসুলভ আচরণ মেনে নেননি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার বাসভবন হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ২ মে ১৯৮০ সালে SAARC প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন।
জিয়াউর রহমানের গঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরি করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়। মিনিস্ট্রি অব কালচারাল এফেয়ার্স, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিশুদের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য নতুন কুঁড়ির আয়োজন করা, টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি শুরু করা, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করা ইত্যাদি নানামুখী উদ্যোগে জনপরিসরে বিএনপি একটি তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
১৯৮১ সালের ৩০মে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়! জিয়াউর রহমানের জানাজায় অগণিত মানুষ এবং তাদের ক্রন্দন প্রমাণ করে দেয়- তার প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা। প্রেসিডন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, জাতিসংঘের মহাসচিব, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শোক প্রকাশ ও বিবৃতি দেয়। বিশ্ব বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয় এই হত্যাকাণ্ড।
————————————————————————————————————-
প্রেসিডেন্ট Ronald Regan তার বিবৃতিতে বলেন : “ I was shocked and deeply grieved to learn of the assassination of President Ziaur Rahman. The United States—indeed the world—had come to respect President Zia’s profound and compassionate commitment to a better life for his people and his dedication to the rule of law.”— BRAIN website.
———————————————————————————————————–
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিকে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য নানান অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। বেগম খালেদা জিয়াকে তখন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দলের নেতৃস্থানীয় সবাই চাচ্ছিলেন, কিন্তু নানান ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি হতে পারেননি।
১৯৮৩ সালের দিকে বিএনপি তিন ভাগে বিভক্ত হয়। তখন বেগম জিয়াকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপার্সন নিযুক্ত করা হয় এবং বিএনপির মূল অংশের নেতৃত্ব দেন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮৪ সালের ১০মে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একটা প্রচারণা ছিল বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার এও প্রচারণা ছিল- বিএনপি সামরিক ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া দল, এর কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি নেই।
বেগম জিয়া জনপরিসরের এই বয়ানকে পুরোপুরি পাল্টে দিলেন। দীর্ঘ ৯ বছর তিনি স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে মাঠে ময়দানে লড়েছেন। বেগম জিয়ার দুইজন সন্তান তখনও যথেষ্ট ছোট। তাকে একাধিকবার গৃহবন্দি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি দমে যাননি। এরশাদ শাসনামলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোনো জাতীয় নির্বাচনেই তিনি অংশগ্রহণ করেননি। আওয়ামী লীগ স্বঘোষিত জাতীয় বেঈমান হয়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও খালেদা জিয়া নিজের ওয়াদার সততা ধরে রেখে ওই নির্বাচন বর্জন করেন। গণমানুষের মানসপটে খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন মনোভাব ফুটে ওঠে।
——————————————————————————————————————–
এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। মানুষের প্রতি ওয়াদা অনুযায়ী সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যাবস্থা প্রবর্তন করেন। বিএনপি যে গণমানুষের দল পূর্বেও ছিল এবং এখনও আছে তা আবার প্রমাণিত হয়। দেশকে আবার গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার জন্য এবং সর্বোপরি আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য খালেদা জিয়ার সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেয়। নারী ও শিশুদেরকে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য উপবৃত্তির ব্যাবস্থা করেন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে টিকাদান কর্মসূচীর আওতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়।
——————————————————————————————————————–
বিএনপি সবসময়ই একটি মধ্যপন্থা দল হিসেবে নিজেদেরকে পরিচালিত করেছে এবং আজও বিএনপি একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি হিসেবেই নিজেদের আদর্শ ধারণ করে। ১৯৯১ সালের পর বিএনপি আবার ২০০১ ক্ষমতায় আসে এবং উন্নয়নের ধারা, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখে।
কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সব বন্দোবস্ত করে। নির্বাচন ব্যাবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। বাংলাদেশের মানুষ পরপর তিনটি নির্বাচনে ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ পায়নি। ১/১১ সরকার এবং তার ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ১৭ বছর বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য চরম জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, গুম করে। কিন্তু বিএনপি গণমানুষের দল বলে এত নির্যাতনের পরও হিমালয়ের মতো অটল থাকে সব কঠিন পরিস্থিতিতে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করার পর দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। ২০১৮ সাল থেকে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
———————————————————————————————————–
বহু অত্যাচার নিপীড়নের পরও বিএনপিকে বিলীন করে দেয়া যায়নি। এর একমাত্র কারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলটির যে ভিত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া সেই ভিতকে আরও শক্তিশালী করেছেন। দুইজনই দলকে মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন, দলের আদর্শ ও কর্মপন্থার কথা বলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
———————————————————————————————————
আশা করা যায়- তিনিও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতো গণমানুষের নেতা হয়ে ওঠবেন। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রত্যাশা বিএনপি পূরণ করতে পারবে এই প্রত্যাশা।
Leave a Reply