নানান আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে আমাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় বারবার—আওয়ামী লীগ কি অনিবার্য ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হয়। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান তো তৈরি হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্ন ছিল, পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ বঙ্গের নেতা তিনি, তিনিই হবেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তা হয়নি।
রাজনীতিতে তিনি তখনো পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে শিশু। অখণ্ড ভারতে সুভাষচন্দ্র বসু ছাড়া আর কোনো বাঙালি নেতা উত্তর ভারতকেন্দ্রিক এলিট নেতৃত্বের কাছে গুরুত্ব পাননি। সোহরাওয়ার্দীর এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে।
পুরো ষাটের দশকে বাংলাদেশে ছিল সামরিক সরকারের আধিপত্য। এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন। এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছিল সামনের কাতারে এবং তখনই নেতা হিসেবে উত্থান হয় শেখ মুজিবুর রহমানের।
মুসলিম লীগের বাঙালি তরুণেরা ঢাকায় বেশ সক্রিয়। নতুন দেশ পাকিস্তান। এই তরুণেরা সোহরাওয়ার্দীর অনুগত এবং কট্টর পাকিস্তানবাদী। কিন্তু ঢাকার মুসলিম লীগ নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার নওয়াবেরা। নিম্নবিত্ত বাঙালি মুসলমানের সেখানে জায়গা কম। ঢাকায় তাদের অনেকের থাকারও জায়গা নেই।
অনেক তরুণ থাকেন মোগলটুলীর মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে। তাঁরা দাবি করলেন দলের গণতন্ত্রায়ণের। দাবি ধোপে টিকল না। ওই সময় এই তরুণদের সামনে হাজির হলেন আসাম-প্রত্যাগত মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হামিদ খান, যিনি মাওলানা ভাসানী নামে পরিচিত। তিনি মুসলিম লীগের কর্মীদের সমাবেশ ডাকলেন ঢাকায়।
সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো টিকাটুলীর কাছে ‘রোজ গার্ডেনে’, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। মাওলানা ভাসানীর প্রস্তাবে তৈরি হলো নতুন রাজনৈতিক দল—পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি হলেন সভাপতি। ঘোষণা করলেন ৪০ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি।
আগেই বলেছি, এই তরুণেরা ছিলেন পাকিস্তানবাদী, তাঁরা সরকারি মুসলিম লীগের পাল্টা ‘আওয়ামী’, অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ তৈরি করলেন। পাকিস্তানে তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে কোনো অঞ্চল নেই। এই অংশের নাম সরকারিভাবে পূর্ববঙ্গ। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের অঞ্চলের নামকরণ করলেন পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেন সাত বছর পর, ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল মুসলমানের রাজনৈতিক দল। অমুসলমানরা তখন কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, গণতন্ত্রী দল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। দেশে চালু আছে ‘পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা’। মুসলমানরা মুসলমান প্রার্থীকে ভোট দেবেন, অমুসলমানরা অমুসলমান প্রার্থী বেছে নেবেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিশ্রুতি দিল, তারা পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাতিল করবে। এর ফলে চুয়ান্নর নির্বাচনে অনেক অমুসলমান নাগরিক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন।
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের কাছে রূপমহল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ফলে আওয়ামী লীগে অমুসলমানদের যোগদানের পথ খুলে যায়। আওয়ামী লীগের বদলে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো ১৯৫৫ সালের দলীয় কাউন্সিল।
ঢাকার মুসলিম লীগের তরুণদের মন্ত্রগুরু সোহরাওয়ার্দী ১৯৫০ সালেই করাচিতে তৈরি করেছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ওই সময় পাকিস্তানি নেতা ইফতেখার হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন জিন্নাহ মুসলিম লীগ। পরে এ দুটো দল একীভূত হয়ে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ।
দল থেকে জিন্নাহ নামটি বাদ পড়েছিল আরও দুই বছর পর, ১৯৫২ সালে। দল থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। কিন্তু মাওলানা ভাসানী এবং দলের অনেক তরুণ তখন দলটিকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সোহরাওয়ার্দী একসময় তাঁর আপত্তি তুলে নেন। এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের তরুণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
পুরো ষাটের দশকে বাংলাদেশে ছিল সামরিক সরকারের আধিপত্য। এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন। এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছিল সামনের কাতারে এবং তখনই নেতা হিসেবে উত্থান হয় শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপস্থাপন করেন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটি স্পষ্ট ফর্মুলা—ছয় দফা। ছয় দফার শুরুতেই বলা হয়েছিল, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’। সত্তর সালে এসে ছয় দফা থেকে বাক্যটি বাদ দেওয়া হয়।
সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তত্ত্ব আগের মতো নেই। এটাই বাস্তব। রাজপথের দল যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে যায়।
আওয়ামী লীগ বরাবরই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছে। ভবিষ্যতে সংবিধানের রূপ কেমন হবে, তার একটি স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে এবং সত্তরের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত প্রাক্নির্বাচনী ভাষণে।
সেখানে বলা হয়, আওয়ামী লীগ কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না। পরবর্তী ৫০ বছরে, আজ অবধি, আওয়ামী লীগ এই প্রতিশ্রুতি রেখেছে।
আওয়ামী লীগের হাত ধরে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ দেশের মানুষ কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামেই যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ শেষে দেশ মুখোমুখি হয়েছে নতুন বাস্তবতার। আওয়ামী লীগের জন্যও এটি নতুন। দলটি এখন আর প্রদেশভিত্তিক বিরোধী দল নয়, এটি স্বাধীন দেশের সরকারি দল।
সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তত্ত্ব আগের মতো নেই। এটাই বাস্তব। রাজপথের দল যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে যায়।
দলটি এখন কেমন—এ প্রশ্ন অনেকেরই। একটি কলামে এর মূল্যায়ন অসম্ভব। ৭ জুন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে ছয় দফা দিবস পালন করেছে। ধানমন্ডি লেকের হাঁটাপথ দিয়ে আমি ফিরছি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে একটি জমায়েত। সেখানে স্লোগান হচ্ছে মুহুর্মুহু। বঙ্গবন্ধুর ছবিতে পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং আরও অনেক নেতা-কর্মী। সে সময়ে দলের কিছু কর্মীর আচরণ খেয়াল করছিলাম। একটা সময় ছিল যখন লোকজন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে রোদ–বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত।
এখন দিন পাল্টে গেছে। সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, লোকজনকে এখন সভা–সমাবেশে নিয়ে আসতে হয়। এর জন্য নাকি বাজেট থাকে। অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগকে এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘আওয়ামী’, অর্থাৎ জনগণের দল হিসেবে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ আজ কতটা ‘আওয়ামী লীগে’ আছে, সেটা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com
Leave a Reply